তাহমিন হক ববী ॥ প্রবাদ আছে আমরা মাছে ভাতে বাঙালী। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের রয়েছে বিশাল মৎস্য সম্পদ। আমিষ জাতীয় এই সম্পদের ভা-ারে আছে অসংখ্য প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জাতের ট্যাংরা। এই ট্যাংরা মাছ বাঙালীর এত প্রিয় যে এর নাম শুনলে যে কোন ভোজনরসিকের জিহ্বায় আপনা আপনি পানি এসে যায়। হাল্কা ঝালে রান্না করা ট্যাংরা মাছের ঝোলের স্বাদই আলাদা। কিন্তু বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খালবিল জলাশয়ে সময়মতো পানি না থাকায় সুস্বাদ ট্যাংরাসহ হারিয়ে যেতে বসেছে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। তাই দেশী বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ আবার ফিরিয়ে আনতে গবেষণা চলছে। গবেষণায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় নীলফামারীর সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা ট্যাংরা মাছের বিপন্ন প্রজাতির কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও পোনা প্রতিপালনের কলা- কৌশল উদ্ভাবন করেন, যা গত জুন মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়।
এবার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে গত ১৯ জুলাই দেশী ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের কৌশল উদ্ভাবনের সাফল্যে সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রকে রৌপ্যপদক প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশী বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন জাতের মাছ গবেষণার মাধ্যমে আবার ফিরে আসছে। এতে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং এর ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। ফলে ফিরে আসবে মাছে ভাতে বাঙালীর গৌরবময় ইতিহাস।
পুকুর, খালবিল, ডোবার সংখ্যা কমে যাওয়ায় দেশী ট্যাংরা প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। বাজারে কালেভদ্রে অল্পস্বল্প মিললেও দাম বেশ চড়া। কিন্তু হারানো ট্যাংরা মাছের প্রজাতিকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশী ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের কৌশল উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রের একদল বিজ্ঞানী। উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খোন্দকার রশীদুল হাসানের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন ও শওকত আহম্মেদ এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। আর এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে এই পুরস্কার সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের আরও একধাপ উৎসাহ জুগিয়েছে অন্যান্য বিলুপ্ত দেশীয় মাছে উদ্ভাবনে। সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রটি ২০০৩ সালে প্রায় ১০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে উত্তরাঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় ৫৪ প্রজাতির দেশী মাছ নিয়ে গবেষণা, জাত উদ্ভাবন, মাছ চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণ ও হাতে-কলমে শিক্ষা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে ৩ জন মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ১৭ জন কর্মচারী। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটসহ দেশী জাতের মাছ চাষ-প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় সৈয়দপুর স্বাদু পানি উপকেন্দ্রে বর্তমানে ১৫টি পুকুরে মাগুর, শিং, কৈ, রুই, কাতলা, জেনাটিক্যালি ইমপ্রুভড তেলাপিয়া, কালচে ও সাদা বর্ণের (গিফট) সরপুঁটি, টেংরা, ভোদা, শোল, টাকি, গুতুমসহ নানা দেশী বিলুপ্তপ্রায় মাছের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নের কাজ চলছে। পুকুরগুলোতে দেশী মাছের লাফালাফিতে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ট্যাংরা গবেষণা দলে থাকা নারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালিহা হোসেন মৌ বলেন, মানুষ এখন বেশি বেশি সুস্বাদু দেশী ট্যাংরা মাছ খেতে পারবেন। এ সাফল্যে পুরস্কার পাওয়ার পর দায়িত্ব-কর্তব্য আরও বেড়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান জানান, ট্যাংরা উদ্ভাবনের পর গুতুম মাছের জাত উদ্ভাবনও প্রায় শেষ পর্যায়ে এসেছে। এ উপকেন্দ্র থেকে সরকারী কর্মকর্তা, মাছ চাষী, খামারিসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ জনকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সফলতা অর্জন করেছেন অনেকেই। ট্যাংরা মাছ উদ্ভাবনে এবার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়ায় দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। তিনি জানান, মিঠা পানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদীনালা, খালবিলে যে মাছগুলো পাওয়া যায়, তার মধ্যে ট্যাংরা মাছ খুবই সুস্বাদু, অনুপুষ্টি সমৃদ্ধ। কাটা কম থাকায় সকলের কাছে প্রিয়। উদ্ভাবনে যে ট্যাংরা নিয়ে আসা হয়েছে তা প্রকৃতির পরিবেশে বেড়ে ওঠা ট্যাংরার সঙ্গে কৃত্রিম প্রজননের ট্যাংরার স্বাদে পার্থক্য হবে না। যে কোন আকারের জলাধারে দেশী ট্যাংরা মাছ চাষ করা যাবে। তবে ১০ থেকে ১৫ শতক আয়তনের ছোট পুকুরে চাষ করা গেলে উৎপাদন ভাল হবে। ডিম ফুটে পোনা বের হওয়ার ৮ থেকে ১০ মাসের মধ্যে এই ট্যাংরা খাওয়ার উপযোগী হবে। এ ক্ষেত্রে চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা মানসম্পন্ন হতে হবে। ৪০-৫০টি ট্যাংরা মাছের ওজন হবে এক কেজি।
তিনি জানান, হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগে ডিম থেকে রেণু পোনা তৈরি করে ১০ দিনের মধ্যে পুকুরে ছাড়া হয়। বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত টেংরা মাছের প্রজননকাল। এ সময় ৮-১০ গ্রাম ওজনের ট্যাংরা সংগ্রহ করে প্রস্তুতকৃত পুকুরে মজুদ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রন্ড তৈরি করা হয়।
রেণু পোনা ছাড়ার আগে পুকুর শুকিয়ে প্রথমে প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন প্রয়োগের পাঁচদিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম টিএসপি ও চার কেজি গোবর ব্যবহার করা হয়। ব্রন্ড প্রতিপালন পুকুরের চারপাশে জালের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা দিতে হবে। একই সঙ্গে নির্দেশিকা মতো খাবার ও যতœ নিতে হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এই কেন্দ্রের উদ্ভাবিত ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন, রেণু পোনা তৈরি ও লালনপালনের প্রযুক্তি মৎস্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করায় এবার জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে পুরস্কার লাভ করেছে। এ ছাড়া ফার্ম ম্যানেজারদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশী জাতের এই ট্যাংরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এতে মানুষ দেশী ট্যাংরা মাছের প্রকৃত স্বাদ পাবে।