ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়

পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেও মুক্তিযোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৬ আগস্ট ২০১৭

পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেও মুক্তিযোদ্ধা

আরাফাত মুন্না ॥ নাম আতিয়ার রহমান ফকির। একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সরকারী চাকরি করেছেন। স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে ছিলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দেশের মানুষকে যখন নির্বিচারে হত্যা করেছে, তখনও পাকিস্তান সরকার বেতন বাড়িয়েছে তার। অথচ ১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকার এই স্বাধীনতাবিরোধীকেই দেয় মুক্তিযোদ্ধা সনদ। এমনই একটি অভিযোগ এসেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা)। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও এই অভিযোগের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ রয়েছে। আতিয়ার রহমান ফকিরকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তার সনদ বাতিল চান অভিযোগকারী। এদিকে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির অনিয়মের কারণে ওই কমিটির পাঠানো মুক্তিযোদ্ধা তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আতিয়ার রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী শেখ মোশারফ হোসেন (মুক্তি বার্তা নম্বর-০৪০৭০২০৫৮৬, গেজেট নম্বর-৯৩১) নিজেকে নড়াইলের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে অভিযোগটি দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি দাবি করেন, আতিয়ার রহমান ফকির মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার পর বসে থাকেননি। সরকারের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তো গ্রহণ করেছেনই, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের প্রভাব খাটিয়ে অনৈতিকভাবেও নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা আতিয়ার রহমানের সার্ভিস বই থেকে তার যুদ্ধের সময়ও চাকরিতে বহাল থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সার্ভিস বইয়ের একটি পৃষ্ঠায় তার ধারাবাহিক বেতন বৃদ্ধির চিত্র দেখা যায়। যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আতিয়ার রহমানের বেতন বৃদ্ধি করা হয়। ১০৬ টাকা থেকে তিন টাকা ইনক্রিমেন্ট যুক্ত করে বেতন হয় ১০৯ টাকা। তার সার্ভিস বইয়ে আরও দেখা যায়, ১৯৭১ সালে ৪ এপ্রিল থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত ৭০ দিন চাকরিতে অনুপস্থিত ছিলেন আতিয়ার রহমান। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি ওই সময়ে লোহাগড়ায় কোন যুদ্ধ হয়নি। এই ৭০ দিন তিনি এলাকায় এসে স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন। পরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে আবারও তিনি চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে অনুপস্থিতির এই ৭০ দিনকে বেতনবিহীন ছুটি হিসেবে সমন্বয় করা হয়। যা তার সার্ভিস বুকে উল্লেখ রয়েছে। এসব বিষয় তুলে ধরে অভিযোগে বলা হয়, তিনি যুদ্ধের সময় চাকরি করেছেন। নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলেছেন। ইনক্রিমেন্টও পেয়েছেন। তাহলে যুদ্ধ করলেন কখন? এ বিষয়ে শেখ মোশারফ হোসেন টেলিফোনে জনকণ্ঠকে বলেন, আতিয়ার রহমান ফকির কখনও কোথাও যুদ্ধে অংশ নেননি। ওই সময়ে সরকারী চাকরি করেছেন। তাহলে তিনি কিভাবে যুদ্ধে অংশ নিলেন। যে সময়টুকু তিনি চাকরিতে অনুপস্থিত ছিলেন, সে সময়েও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের সহযোগিতা করেছেন। পরে আমরা চাপ দিলে এলাকা ছেড়ে আবার চাকরিতে চলে যান। তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে দেশ স্বাধীন করেছি। অনেক সহযোদ্ধা আমাদের সামনে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধে আমারও প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। আতিয়ার রহমান ফকির মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এখন তিনি মারা গেলেও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাবেন। সেটা মেনে নিতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তার মতো যদি একজন স্বাধীনতাবিরোধীও রাষ্ট্রীয় সম্মান পায় তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে এর চেয়ে অপমানের আর কিছুই হতে পারে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধ যাচাই-বাছাই কমিটিতেও অভিযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু টাকার বিনিময়ে সবাই ম্যানেজ হয়ে গেছে। আতিয়ার রহমান ছাড়াও আরও অনেককেই টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছেন কমিটির সদস্যরা। এ বিষয়ে আতিয়ার রহমান ফকির নড়াইলে জনকণ্ঠের নিজস্ব সংবাদদাতার কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ায় স্বাস্থ্য সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন বলে স্বীকার করলেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চাকরি ফেলে এলাকায় চলে আসেন। ২৫ মার্চ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। লোহাগড়া থানা এবং গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পর কর্মস্থলে ফিরে যান। এ বিষয়ে যুদ্ধকালীন নড়াইল মহকুমার মুজিব বাহিনীর প্রধান এবং সাবেক সংসদ সদস্য শরীফ খসরুজ্জামান জনকণ্ঠকে টেলিফোনে বলেন, আতিয়ার রহমান কখনও কোথাও যুদ্ধে অংশ নেননি। তিনি যুদ্ধের সময়ও সরকারী চাকরি করতেন। বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে আসতেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এমন সুপারিশ নিতে। তিনি নিজেই সুপারিশ লিখে নিয়ে এসে বলতেন আমাকে স্বাক্ষর দিতে। আমি তাকে অনেক বারই ফিরিয়ে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, আমি এখনও বলছি, আতিয়ার নড়াইলে কোন যুদ্ধেই অংশ নেননি। তবে, তিনি অনেক ক্ষেত্রে আমার নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার পক্ষে মিথ্যা বক্তব্য তুলে ধরছেন। যার সঙ্গে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। লোহাগড়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির অনিয়মের কথা জানালেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকও। তিনি বলেন, লোহাগড়া উপজেলায় বর্তমানে তালিকাভুক্ত হিসেবে যতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক নাম নতুনভাবে যুক্ত করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি। আমরা ওই তালিকা স্থগিত করে দিয়েছি। কি কারণে তারা এত সংখ্যক নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত করল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লোহাগড়া উপজেলার আতিয়ার রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এমন একটি অভিযোগের কথা শুনেছি। অভিযোগ যাচাই- বাছাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। টাকার বিনিময়ে যদি কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে তিনি পার পাবেন না এবং যারা টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করেছেন তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান মন্ত্রী।
×