ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কেমন চলছে রাজধানীর অবশিষ্ট সিনেমা হলগুলো

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৬ আগস্ট ২০১৭

কেমন চলছে রাজধানীর অবশিষ্ট সিনেমা হলগুলো

হাসান ইমাম সাগর ॥ সিনেমা নাই। দর্শক নাই। হল চালামু কেমনে। নতুন সিনেমা চালালে দু-একদিন কিছু দর্শক পাওয়া যায়। অন্য সময় কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া হলের বারান্দায়ও কেউকে পাওয়া যায় না। লাভ তো দূরের কথা বিদ্যুত খরচাও ওঠে না। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে গুনতে পুঁজিপাট্টা সব শেষ। ভাবতেছি এটা ভেঙ্গে মার্কেট করব। আগে মাসে ৪-৫টা সিনেমা রিলিজ হতো। এখন মাসে একটাও রিলিজ হয় না। যাওবা হয় তা আবার আগেই পাইরেসি (মুক্তি পাওয়ার আগে চুরি) হয়ে যায়। পাইরেসি সিনেমা হলে আসার আগে দর্শকদের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। তাতে আমাদের পুরাটাই লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ সিনেমা ভারত-বাংলা বা তামিল সিনেমার কপি। মৌলিক সিনেমা খুব কমই রিলিজ হয়। মৌলিক সিনেমা চালালে দর্শক কিছু বাড়ে। এ নকল সিনেমা দেখতে লেবার, রিক্সাওয়ালা, গার্মেন্টস শ্রমিক, পিকআপচালক বা ভ্যানচালক ছাড়া শিক্ষিত বা অন্য কোন শ্রেণীর দর্শক আসে না। বর্তমান মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ। টিভি চ্যানেলও কম নাই। এতে দেখা যায় এ শ্রেণীর দর্শকও নকল সিনেমা দেখতে চায় না। এসব কারণে আমরা হলের একাংশ ভেঙ্গে মার্কেট করছি। বাকি অংশ ভাঙ্গার পরিকল্পনা চলছে। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক সংখ্যা কমে যাওয়া এবং হল ভেঙ্গে ফেলার কারণ জানতে চাইলে এমন কিছু কথা বলছিলেন রাজধানীর মিরপুর-১ এর সনি সিনেমা হলের পরিচালক বরুন সরকার। রাজধানীর পুরান ঢাকায় এখনও ধুঁকে ধুঁকে প্রায় ৭-৮টি সিনেমা হল চলছে। এদের মধ্যে তাঁতীবাজারে ইংলিশ রোডে অবস্থিত বহু পুরাতন একটি সিনেমা হল চিত্রা মহল। এ হলে মাঝে মাঝে দর্শক সমাগম ভালই হয়। এই হলে নিয়মিত সিনেমা দেখতে আসা এমন এক দর্শকের কাছে একই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পুরান ঢাকার যে কোন হলে ঢুকতে নাকে রুমাল বাঁধতে হয়। সিটে বসলে ছারপোকা কামড়াতে থাকে। অধিকাংশ সিট ভাঙ্গা। হাতল নাই। ১০-১৫ মিনিট পর ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ লাগে। নতুন ছবি লাগালে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়। হলের সামনে দর্শক সংখ্যা একটু বেশি দেখলে কাউন্টার ম্যান সঙ্গে সঙ্গে ব্লাকারদের হাতে টিকেট ছেড়ে দেয়। এতে করে ৩০ টাকার টিকেট ১০০ টাকায় কিনতে হয়। যার কারণে মানুষ এখন হলে আসা ছেড়ে দিছে। যারা আসে তারা এক প্রকার বাধ্য হয়েই আসে। কারণ তাদের বিনোদনের জায়গা নাই। সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার চিত্র মহল, অভিসার, আজাদ ম্যানসন, মানসী, হলের সামনে ভাসমান পতিতাদের আড্ডা। শো শুরু হলে এসমস্ত হলের কিছু অসাধু কর্মচারী সহায়াতায় হলের মধ্যে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। এতে পরিবারের মা-বাবা, ভাইবোন কিংম্বা আত্মীয়স্বজন নিয়ে হলে বসে সিনেমা দেখা অনেক দুরূহ এবং লজ্জাজনক বলে অভিযোগ করেছেন বেশকিছু দর্শক। অধিকাংশ সিনেমা হলে টিকেট বিক্রি হচ্ছে না। ৮০০ আসনের বিপরীতে এক শোতে ২০টি টিকেটই বিক্রি হয় না। নাইট শো মাঝে মাঝে বন্ধই থাকে। দিনের বেলায় ১০-১৫ জন দর্শক নিয়ে চালানো হচ্ছে একটি শো। নেই পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারী। হলের ভেতর পর্যাপ্ত সিট থাকলেও তা ভাঙাচোরা, ফোম উঠে গেছে। নেই দর্শকদের জন্য স্বাস্থ্যকর টয়লেটের ব্যবস্থা। বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমা বা চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমও বলা হয়। একটি ভাল চলচ্চিত্র শিল্প অর্থনীতিতে রাখে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এবং এ চলচ্চিত্র বিনোদনমূলক বাণিজ্যের অন্যতম একটি ক্ষেত্র। আর এ বাণিজ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে দেশের সিনেমা হলের বিকল্প নাই। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে এখনও আধুনিকতার কোন ছোঁয়া লাগেনি। কয়েকটি সিনেমা হল ছাড়া অধিকাংশ সিনেমা হলে বসার আসন থেকে শুরু করে সাউন্ড সিস্টেম পর্যন্ত সবই চলছে পুরাতন ধাঁচে। সপরিবারে ভালভাবে উপভোগ করার মতো সিনেমা হল এখন আর নাই বল্লেই চলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সিনেমা হল বিংশ শতাব্দির পঞ্চাশ দশকে নির্মিত হয়। সত্তর, ষাট এবং আশির দশকে এ সিনেমা হলগুলো পূর্ণোদমে সচল ছিল। পরবর্তী সময়ে নব্বই দশকের শেষদিকে এসে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হতে থাকে। বেশিরভাগ সিনেমা হল ভেঙ্গে তৈরি করা হচ্ছেÑ বহুতল বাণিজ্যিক ভবন ও মার্কেট। ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ১৩শ’টি সিনেমা হলের মধ্যে বর্তমান সিনেমা হলের সংখ্যা কমে ২শ’টির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক সুবিধা সম্বলিত হল, মানসম্মত চলচ্চিত্র, পরিচালনায় অনিয়ম ইত্যাদি সমস্যার কারণে বাংলাদেশের হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে সিনেমা হল নির্মাণের উদ্যোগও নিচ্ছে না কেউ। সিনেমা ব্যবসায় ধস নামার কারণ সিনেমা ব্যবসায় ধসের অন্যতম কারণ পুরাতন সিনেমা দিয়ে শো চালানো। পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের জেলা পর্যায়ের হলগুলোতে এখনও চালানো হচ্ছে অশ্লীল সিনেমা। এছাড়া ভালমানের শিল্পীর অভাব, নকল গল্প ও গান, একঘেঁয়েমি কাহিনী, পুরাতন সরঞ্জাম দিয়ে সিনেমা তৈরি ইত্যাদি কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সিনেমা ব্যবসায়। অনেক দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে দেখতে পায় যে সেটি হিন্দি চলচ্চিত্রে নকল। প্রতিটি চলচ্চিত্রই দেখা যায় কোন না কোন ভারতীয় তথা বলিউড ও টালিউডের ছবির আদলে তৈরি করা হয়েছে। ফলে কেন মানুষ সিনেমা হলে চলচ্চিত্র দেখতে যাবে? মূলত এসব কারণেই দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর এভাবেই ধ্বংস হচ্ছেÑ সিনেমা ব্যবসা। কর্মব্যস্ত মানুষের ক্লান্তি দূর করতে প্রয়োজন হয় বিনোদনের। চলচ্চিত্র বিনোদনের পাশাপাশি একটি শিল্পও। একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিল্প-সংস্কৃতি বোঝার অন্যতম মাধ্যমও এটি। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ওই দেশের মানুষের সাধারণ কৃষ্টি কালচার ফুটে ওঠে একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এতে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণা দূর করতে একটি চলচ্চিত্রই যথেষ্ট। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি মানসম্মত ভালমানের চলচ্চিত্র তৈরি করতে প্রয়োজন হয় প্রচুর অর্থের। আর এ অর্থের অন্যতম যোগান পাওয়া যায় সিনেমা হল থেকে। কিন্তু দর্শক সঙ্কটে হল মালিকদের এ অর্থের যোগান দেয়া অত্যন্ত কঠিন। ফলে একটি উন্নতমানের চলচ্চিত্র তৈরি করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানালেন নির্মাণাধীন ডেঞ্জার জোন সিনেমার নবীন পরিচালক বিলাল সানি। তবে আমি (বিলাল সানি) সবকিছু উপেক্ষা করে একটি আন্তর্জাতিকমানের সিনেমা তৈরি করার চেষ্টা করছি। এ সিনেমাটি ২০১৭ সালের মধ্যেই রিলিজ পাবে। এ সিনেমাটি বাংলাদেশের পেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নতুন ধারার একটি মুভি হবে এবং এ সিনেমায় প্রচুর দর্শকের সাড়া পাব বলে আশা করছি। সিনেমা হলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের পরিচালক সালাউদ্দিন জানান, সিনেমা হলের ব্যবসায় ভাল অবস্থা নেই। সিনেমা হলে একটি এয়ারকন্ডিশন (এসি) বসাতে প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রয়োজন। অত্যাধুনিক চেয়ারের জন্য প্রচুর বাজেটের দরকার। কিন্তু সে রকম আয় ইনকাম না থাকার কারণে আমরা অবকাঠামোগত কোন উন্নয়ন করতে পারছি না। তাই যে হলগুলো আছে অচিরেই সেগুলো থাকবে না। তিনি আরও বলেন, আগে বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এত স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না। এখন নতুন নতুন হিন্দি ছবি স্যাটেলাইটে দেখাচ্ছে। ফলে মানুষ এখন সিনেমা দেখতে হলে আসতে চায় না। সিনেমা ব্যবসার অতীত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে করণীয় সিনেমা হলের অতীত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে করণীয় কি? এ প্রশ্নের জবাবে বেশ কয়েক জন হল পরিচালক বলেন, হলের অবস্থা ভাল না থাকলে ভাল সিনেমা হবে না। আবার ভাল সিনেমা না হলে হল ভালভাবে চালানো যায় না। একটি সিনেমা হলে ১৫০০-২০০০ আসনের দরকার নেই। প্রত্যেক জেলা শহরে একটি করে সিনেপ্লেক্স তৈরি করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকতে হবে। সিনেমা ব্যবসায় ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে। নতুন আর্টিস্ট তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
×