ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদী, মাফ পাবে না

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২৬ আগস্ট ২০১৭

নদী, মাফ পাবে না

নদীটা অনেক দূরেই ছিল। এক রাতেই নদীটা চলে এল বাড়ির কাছে। হাশেম চাচার গলা শুনেছিলাম আমি। খুব সকালেই শুনেছিলাম। দূর থেকে ভেসে আসছে কথাগুলো। এক সময় কাছে চলে আসে। ছুটতে ছুটতে আসছেন চাচা। বলছেন, পানি বাড়তাছে। সবাই সইরা পড়। বানের পানি ভাসাইয়া নিব কইলাম। আমি খুব চমকে উঠলাম। নদীটা তাহলে আসছে! আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। তাই দেখে মা তো অবাক। গোছগাছ করছেন, সরে পড়তে হবে। আর তাই তখন কিছু বললেন না। অনেকটা পথ পার হয়ে এলাম স্কুলে। আমাদের স্কুলে। একটু উঁচু জমি স্কুলের। বানের পানি এখানে আসতে পারবে না। উঁচু জায়গা তো, তাই। আমরা এখানে এসেছি এই কারণেই। পানি নেমে গেলে আবার চলে যাব। বাড়ি যাব। আমি যাব আমার বাড়ি। টিটু যাবে টিটুর বাড়ি। মরিয়ম যাবে মরিয়মের বাড়ি। হাশেম চাচা যাবেন হাশেম চাচার বাড়িতে। ততদিন এখানে থাকতে হবে। এটুকু ভেবে হাশেম চাচা কাঁদেন। এখানে থাকতে চাচার নাকি ভাল লাগে না। একটুও না। আমার কিন্তু ভাল লাগছে। আমাদেরই স্কুল, নিজের বাড়ির মতোই আপন। বাড়িতে টিটু, মরিয়মের সঙ্গে থাকা হয় না। এখানে তো ওরাও থাকছে। আমরা দিন নেই রাত নেই, খালি বকবক করি। আমাদের স্যার আর আপারাও আছেন এখানে। আমাদের বকবকানি দেখলেন হেডস্যার। তারপর নাকি স্যার আর আপাদের বলেছেন পড়াতে। পড়ালেখা হবে। বইখাতা আছে। বানের পানি আসার আগেই এসব ভাবা হয়েছে। বইখাতা নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়েছে। দোতলায় একটা ঘরে মাচা বানানো হয়েছিল। সেখানেই পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা আছে বইখাতা। টিটু বলে, লালিরে যদি পলিথিনে মুড়াইতে পারতাম! মাচার উপরে রাখতে পারতাম! নিরাপদে থাকত লালিটা। আমি জানি, লালি কে। টিটুর পেলেপুষে বড় করা লালি। লাল ছাগলটা। খালি ব্যা ব্যা করে। লালিকে রাখা হয়েছে স্কুল ঘরের এক পাশে। উপরে টিন দিয়ে ছাদ বানানো হলো। লালির মতো আরও ছাগল-গরু-মুরগিরা থাকছে ওখানে। উঁচু জমি এখানে। বানের পানি আসবে না। টিটুর তবু ভাবনা হয়। লালিরে যদি পলিথিনে মোড়ানো যেত! মাচার ওপর রাখা যেত! আহা রে লালি! বানের পানি কতটুকু এসেছে? মরিয়মের ছোট ভাইটা আজব কিসিমের। খালি হাসে। কথা বলতে পারে না। বোঝেও না কিছু। মানুষের ভিড় এখানে। শামসু খালি হারিয়ে যায়। শামসুটা কে? মরিয়মের ছোট ভাই। মরিয়ম একটু পর পর ছোটে। শামসুকে খুঁজতে হয়। আমরাও ওর সঙ্গে থাকি। শামসুকে খুঁজি। এ্যাতো এ্যাতো মানুষের ভিড় এখানে। আমরা ‘শামসু শামসু’ বলে ডাকি। জবাব মেলে না। শামসুর মুখে কথা নেই। জবাব দেবে কী করে? মরিয়মের মা কেবলি ভাবনায় পড়েন। পাগল ছেলেটা যদি হারিয়ে যায়? শামসুকে পাগল বললে মরিয়ম রেগে যায়। মা বললে রাগে। অন্য কেউ বললে তো খেপে যায়। শামসু তো পাগল না। ওকে কেন পাগল বলবে কেউ? আহা রে শামসু! আমিও বলি, তাই তো! শামসু তো পাগল না। টিটু বলে, শামসু প্রতিবন্ধী। তাই না রে? মরিয়ম চোখে পানি নিয়ে তাকায়। বলে, না। স্যার আপারা কি শিখাইছেন? মনে নাই? শামসু হইল বিশেষ শিশু। ও আর সবার মতো না। ও শুধু ওর মতো। মরিয়ম বলে, শামসুরে যদি বইখাতার মতো রাখতে পারতাম। ব্যাগের মইধ্যে রাখতাম। শামসু আর হারাইতে পারত না। মরিয়মের এই কথা শুনে আমি ভাবি। কেবলি ভাবি। কেন যেন মনে হয়, ভাবলে কাজ হবে। আসলেই কাজ হয় ভাবনায়। বড় একটা গামছারে কাজে লাগাই। মরিয়মের পিঠে ঝুলিয়ে দিই। বুকের কাছে দিই গামছার গিঁট। মরিয়মের পিঠে গামছাটা ঝোলে। ব্যাগের মতো। এর দুই দিকে ফাঁকা। শামসুকে ব্যাগের ভেতর বসিয়ে দিই। দুই পাশের ফাঁকা দিয়ে দুই পা দেয় বের করে। মরিয়ম শামসু-ব্যাগকে পিঠে নিয়ে ঘোরে। শামসু খুব মজা পায়। হাসে। আমরাও মজা পাই। শামসু-ব্যাগকে পিঠে নিতে চাই আমি আর টিটু। পালা করে মজা নেই আমরাও। শামসু-ব্যাগ আমার পিঠে ঝোলে। শামসু-ব্যাগ টিটুর পিঠে ঝোলে। শামসু আর হারাতে পারে না। কী মজা! সারাদিন মজাতেই আছি। খেলতে মজা। পড়তে মজা। পেট ভরে খেতে পাই না, তাও মজা। আমাদের মজা দেখে বড়রা রাগ করে। বড়দের মুখে খালি থমথমে ভাব। খালি ভাবনা। বানের পানি নিয়ে ভাবনা। ফেলে আসা বাড়িঘর নিয়ে ভাবনা। বানের পানিতে ডুবে যাওয়া ফসলের ভাবনা। পানি নেমে গেলে কি কি করতে হবে, সেই ভাবনা। বানের পানি কতটুকু এসেছে? আমি ছুট দেই। দেখতে যাই, বানের পানি কতটুকু এসেছে। শুকনো জমি কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। পানি আসছে এগিয়ে। নদীর পানি। উঁচু জমিতে দাঁড়িয়ে পানি দেখি। নদীকে দেখি। বানের পানি তো নদীরই পানি। মা কেবলি ভাবনা করেন। আমি কেন বানের পানি দেখতে যাই? আহা রে বানের পানি! সবাই বলাবলি করে ঈদের কথা। কোরবানির ঈদ হবে। আর কদিন পরেই হবে। তখন খুব মজা হবে। আমি জানি, এগুলো সত্যি না। ঈদে কোন মজা হবে না। ঈদে কোন মজা হয় না। সত্যি বলছি, দুই বছর আগে ঈদে মজা হ’ত। এরপর থেকে হয় না। টিটু আমার বন্ধু। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, খোকা! এই পানির ভেতর ঈদ কি হবে? ঈদ তো হবেই। ঈদ তো আসেই হওয়ার জন্য। মরিয়ম আমার চুল নেড়ে দেয়। বলে, খোকা রে! ঈদ যদি হয় তো মজাও হবে। হেড স্যার বলেন, বানের পানি এখানে আসবে না। ঈদ হবে। মজাও হবে। আমি জানি, বানের পানি এইখানেও আসবে। আমার কাছে আসবে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, অলুক্ষণে কথা বলিস্ না খোকা। বানের পানি যেন না আসে এখানে। আসবে। আমি জানি আসবে। কেন আসবে? দুপুরের একটু পর। আমার পায়ের পাতা ছুঁয়ে যায় পানি। হু হু করে কাঁদে। এসে গেছে নদী। আমার কাছে মাফ চাইতে এসে গেছে। আমি সোজা বলে দেই, শোন নদী! তোমাকে আমি মাফ করব না। দুই বছর আগের কথা মনে কর। বাবা গিয়েছিল তোমার বুকে। মাছ ধরতে। তারপর আর বাবা নেই। বাবাকে কেড়ে নিয়েছ তুমি! আমি তোমাকে মাফ করব না। আমার পায়ে পড়েছ, তাতে কি? তোমার মাফ হবে না। কিছুতেই না। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×