ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘নায়করাজ রাজ্জাক : মৃত্যুর পরও তিনি রাজা’

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৬ আগস্ট ২০১৭

‘নায়করাজ রাজ্জাক : মৃত্যুর পরও তিনি রাজা’

সাজু আহমেদ ॥ বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের কিংবদন্তি অভিনেতা, পরিচালক, প্রযোজক নায়করাজের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র শিল্পে অনেকটাই শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। চলচ্চিত্রশিল্পের দুর্দিনে নায়করাজ রাজ্জাকের মহাপ্রয়াণ সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের ব্যথিত করেছে। বিশেষ করে শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তার সহকর্মী সুচন্দা, ববিতা, কবরী, শাকিব খান এবং নির্মাতা ও কলাকুশলীসহ সংশ্লিষ্ট অঙ্গনের মানুষরা। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন নায়করাজের ৫০ বছরের অধিক সময়ের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি তার ভালবাসা, কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা, সংশ্লিষ্ট শিল্পী এবং কলাকুশলীদের প্রতি তার যে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা ছিল তা বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য অনেকটা শিক্ষীনয় বটে। বিশেষ করে নায়করাজের মৃত্যুর তার সহশিল্পীরা যেভাবে শোক প্রকাশ করেছেন, তার জন্য কেঁদেছেন, শহীদ মিনারে সর্বশ্রেণীর মানুষ তাকে যে সম্মান জানিয়েছেন, এই প্রজন্মের শিল্পীরা যারা এখন কাজ করেছেন তারা চলেও যাওয়ার পর ক’জন এভাবে শোক প্রকাশ করতে পারেন? তাদের অর্জনই বা কতটুকু। এসব বিষয় বিবেচনা করে বর্তমান শিল্পী ও কলাকুশলীদের আরও সজাগ হওয়ার অবকাশ রয়েছে। অত্যন্ত নায়করাজের শূন্যতা পূরণে তার আদর্শ এবং কর্মযজ্ঞের অনুসরণ অবশ্যই কাম্য। পাশাপাশি সকল ভেদাভেদ ভুলে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে সবাই এক হয়ে কাজ করার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ২০০৮ সালে চিত্রনায়ক মান্না মারা যাওয়ার পর বিএফডিসিতে আর কারও জানাজায় এত লোক সমাগম হয়নি, যতটা না নায়করাজের জানাজায় হয়েছে। এমন কোনো চলচ্চিত্র শিল্পী নেই যিনি নায়করাজের মৃতুতে ছুটে আসেননি। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে ও সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে নায়করাজকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে এসেছিলেন সেটি সর্বশেষ উপন্যাসিক ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরই দেখা গিয়েছিল। খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নায়করাজের জন্য শোক প্রকাশ করেননি। ফেসবুক ওয়ালের সর্বত্র কেবলই নায়করাজ রাজ্জাকের প্রতি শ্রদ্ধা আর স্মৃতিচারণ। এসব কিছু দেখে তাই বলা যায়, নায়করাজ রাজ্জাক তার জীবদ্দশায় যেভাবে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নিজের দাপট দেখিয়েছেন, তেমনি মৃত্যুর পরও তিনি মহানায়ক হয়ে সর্বত্রই তার দাপট দেখালেন। এ জন্যই তাকে বলা যায়, চলচ্চিত্রের অপরাজিত একচ্ছত্র মহারাজা। আর এ রাজাকে তাই প্রতি মুহূর্তে সকলেই মিস করবে। সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে একটা অভিযোগ প্রায় প্রচলিত। সিনিয়রদের অনেকেই জুনিয়রদের উত্তরসূরি ভাবেব না। চলমান ধারাবাহিকতা রক্ষায় জুনিয়রদের কে কাছে টেনে নেন না তাদের দীক্ষা দেন না। তেমনি আবার কিছু কিছু জুনিয়র শিল্পী বা কলাকুশলী আছেন যিনি একটু আধটু কাজ করেই জনপ্রিয়তায় গা ভাসিয়ে অগ্রজদের সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। এই একটি মাত্র বিষয় থেকে শিল্পী সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অথচ সবাই মিলে এক সঙ্গে কাজ করলে যে কোন শিল্পই তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে অধিষ্ঠিত হতে পারে। এই অভিযোগ বা সমালোচনা শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে নয়। সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। এই অবস্থায় উত্তরণে অচিরেই সজাগ হওয়া উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে সংবাদকর্মী রেজাউর রহমান রিজভী বলেন, নায়করাজ রাজ্জাকের প্রাণহীন দেহটি যে খাটিয়ায় করে কবরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেই খাটিয়ার এক প্রান্তে ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ঢাকাই চলচ্চিত্রের বর্তমান সুপারস্টার শাকিব খান। আরেক প্রান্তে ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। নায়করাজের তিন পুত্র চিত্রনায়ক বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও চিত্রনায়ক সম্রাট ছাড়াও খাটিয়া বহন করছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের অন্যতম ক্রেজ ফেরদৌস, আশির দশকের পর্দা কাঁপানো নায়ক উজ্জ্বলসহ নায়করাজের সহকর্মী, অনুজ ও ভক্তরা। নায়করাজকে সমাহিত করার পর চিত্রনায়ক শাকিব খানকে বাপ্পারাজ বললেন, জায়েদ খানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। শাকিব কালক্ষেপণ না করে জায়েদ খানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘জায়েদ তোরা আমার ছোট ভাই’। মুহূর্তের মধ্যেই একটি ইতিহাস রচিত হলো। অথচ চলতি বছরের মে মাসে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জল গড়িয়ে ছিল অনেক দূর। ঘটনার ব্যাপকতায় শাকিব খানকে পরবর্তীতে নিষিদ্ধও করা হয়। তবে চলচ্চিত্রের শুভাকাক্সিক্ষরা উভয়পক্ষকেই একত্রিত করতে চাইছিলেন। কিন্তু বিষয়টা এতটাই জটিল ছিল যে, ব্যাটে-বলে এক হচ্ছিল না। অবশেষে নায়করাজের মৃত্যুই যেন সব ঘটনার যবনিকা টেনে দিল। শাকিব-জায়েদ একে অপরের বুকে বুক মিলিয়েছেন। পুরো বিষয়টি স্বপ্নের মতো মনে হলেও এটাই এখন বাস্তব। আগামীতে সবাইকে নিয়ে পরিপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র পরিবারের স্বপ্ন তাই দেখা তো যেতেই পারে। আবার চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাপরিচালক বদিউল আলম খোকন বেশকিছু দিন আগে নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে কটূক্তি করেছিলেন। তখন তাৎক্ষণিকভাবে সে কথার প্রতিবাদ করেছিলেন পরিচালক গাজী মাহবুব। এতে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হয়। নায়করাজের পরিবারও এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু নায়করাজের মৃত্যুর পর এই বদিউল আলম খোকনই বিএফডিসিতে তিন দিনের জন্য চলচ্চিত্রের শূটিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এমনকি নায়করাজের মৃত্যুর দিন তাৎক্ষণিকভাবে বিএফডিসিতে একটি চলচ্চিত্রের শূটিং বন্ধেরও উদ্যোগ নেন’। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন যে শুধু শূটিং বন্ধ নয়, চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন এবং ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নায়করাজে আদর্শ ও নিষ্ঠাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তার মতো শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সবাই এক হয়ে কাজ করবেন এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। পাশাপাশি নায়করাজের স্মৃতি ধরে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
×