ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৬ আগস্ট ২০১৭

৫ মে ২০১৩ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব

(২৩ আগস্টের পর) ৪ মে সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। সকল দিক পর্যালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী এই সমাবেশ যাতে আইন অমান্য করে ঢাকার কোন স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে সেজন্য দৃঢ়তম নির্দেশ দেন। তিনি গণতন্ত্র ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকরণে সর্বাত্মক দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সকলকে অনুশাসন দেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী সেই রাতেই আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সম্ভাব্য সকল ঘটনা মোকাবেলা করার জন্য বিস্তারিত প্রস্তুতি নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ৫ মে সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে হেফাজতীদের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্দলীয় সরকার গঠনের জন্য ৪৮ ঘণ্টার যে আল্টিমেটাম খালেদা জিয়া এই প্রেক্ষিতে দেন তা সর্বাংশে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ঘোষণা করেন যে, তাদের সমাবেশ প্রতিরোধে প্রয়োজন হলে হেফাজতীদের ঢাকা ঢুকতে দেয়া হবে না। তিনি হেফাজতীদেরকে ’৭১-এর পরাজিত শত্রুর প্রেতাত্মা ও রাজাকার আলবদরের নতুন প্রজন্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেন (দ্রষ্টব্য: দৈনিক জনকণ্ঠ ৬/৪/১৩)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অধিনায়ক ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আশঙ্কিত ঘটনার প্রকৃতি ও সম্ভাব্য গতিবিধি এবং যৌক্তিক প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি পর্যালোচনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আমি নির্দেশ দেই যে, হেফাজতীদের শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ অনুষ্ঠানে কোন বাধা দেয়া হবে না। কিন্তু জোরপূর্বক দোকানপাট লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নিজেদের বা বাইরের কোন সংগঠন/উপসংগঠনের সঙ্গে তারা সংঘাতে লিপ্ত হলে, সাধারণ জনগণ, সিটি কর্পোরেশন ও সরকারের সম্পদ বিনষ্ট করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি সিদ্ধান্ত দেই। এদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আমি এও স্থির করি যে, সমাবেশে উশৃঙ্খল আচরণ করলে তা ভেঙ্গে দেয়া ও দমন করার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দক্ষিণে ইত্তেফাক মোড় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর-পূর্ব দিকে জসীম উদ্দীন সড়ক খোলা রেখে উশৃঙ্খল হেফাজতীদের প্রতিকূলে পশ্চিমে জনতা ব্যাংক ও উত্তরের নটর ডেম কলেজের সড়ক ধরে পুলিশ ও র‌্যাব এগিয়ে যাবে। যেহেতু র‌্যাবের কাছে দেয়া আগ্নেয়াস্ত্রে কেবলমাত্র প্রাণঘাতী এবং পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য অপ্রাণঘাতী বুলেট দেয়া হয় সেহেতু যথাসম্ভব কম আঘাতে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই বিবেচনায় বাহিনীর মোতায়েন মিশ্রণে র‌্যাবকে পুলিশ বাহিনী পেছনে সংরক্ষিত বা রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে মোতায়েন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তেমনি বিজেবির প্লাটুন সমূহকে (প্রায় ২৫ সংখ্যক) একই কারণে সুপ্রীমকোর্টের পূর্বদিকে সংরক্ষিত বাহিনী হিসেবে মোতায়েন রাখা হবে বলে স্থিরিকৃত হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, র‌্যাব ও বিজিবিকে পেছনে রেখে পুলিশ গোলাবারুদ, কাঁদানে গ্যাস ও আওয়াজী গ্রেনেড নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল সমাবেশ ভেঙ্গে দিবে। এক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদকে। তার তত্ত্বাবধানে যথাযথ কর্তব্য পালনের নির্দেশ দেয়া হয় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবদুল জলিল ও উপ-কমিশনার মারুফ হোসেনকে। র‌্যাবের নেতৃত্বে রাখা হয় লে. কর্নেল জিয়াউল আহসানকে। বিজিবি বাহিনীর দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইয়াহিয়া আজম খানকে। এও স্থিরিকৃত হয় যে, মাওলানা শফী যদি সমাবেশে যোগ দিয়ে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সমাবেশের সমাপন ঘোষণা করতে প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে তাকে সমাবেশে আসতে দেয়া হবে। আর এই ধরনের প্রতিশ্রুতি তার থেকে না পাওয়া গেলে সমাবেশে তাকে তার প্রধান সহযোগীদের সঙ্গে যোগ দিতে দেয়া হবে না। এই সময় মন্ত্রিপরিষদের আমার কতিপয় সহযোগী আমাকে সম্ভাব্য পরিস্থিতি দ্রুততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রযুক্ত করার পরামর্শ দেন। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে আমাকে জানান হয় যে, তারা নগরের ২৭টি স্থানে সহজে নিজেদের মোতায়েন করতে পারবে। আমি আমার সহযোগীদের বলি যে, গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা এবং সকল বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা থেকে জনগণকে মুক্ত রাখা সুশীল ও গণতান্ত্রিক সরকারের সক্ষমতার পরিচয় বহন করবে এবং এই পরিচয় সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে জননেত্রী শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক সুস্পষ্ট করা ও রাখার জন্য ঐ সময় এক্ষেত্রে বেসামরিক বাহিনীর যোগ্যতা ও কার্যক্ষমতা প্রমাণ করা কর্মানুগ ও লক্ষ্যানুগ হবে। পরের দিন ৫ মে বেলা ১১টা থেকে পল্টন, ইত্তেফাক মোড় হয়ে এবং নটর ডেম কলেজের সামনে দিয়ে প্রায় সকল সড়ক ধরে হেফাজতের কর্মীরা লাঠিসোঁটা, লোহার রড, হকিস্টিক এমনকি দা, কুড়াল নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এদের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াতে ইসলাম ও ছাত্র শিবিরের জঙ্গী লাঠিয়াল ও বোমাবাজ কর্মীবৃন্দ। একই সময় মতিঝিল ও পল্টনসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হেফাজত কর্মীরা এদের সঙ্গে মিলে ইটপাটকেল ও লাঠিসোঠা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমাদের বিবেচনায় বিডিআর বিদ্রোহের পর হেফাজতীদের এই তা-ব শেখ হাসিনার শাসনামলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিকূলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। ৩ থেকে ৫ মে সকাল পর্যন্ত আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খবর পেয়েছিলাম যে, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির প্রধান জেনারেল এরশাদ মাওলানা শফীর দাবিসমূহ ও ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য হেফাজতীদের সমাবেশ সমর্থন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে আমার সঙ্গে পরিচিত এক কালের বামপন্থী নেতা এবং সে সময় স্বৈরশাসক এরশাদের পাবন্দ কাজী জাফর দৃশ্যত অসুস্থ শরীর নিয়েও ৫ মে সকাল ১০টার দিকে এই সমাবেশে যোগ দেন। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হই। আমি জানতে পারি কাজী জাফর এরশাদের তরফ থেকে সমাবেশ সমর্থন করে মতিঝিল এলাকায় উপস্থিত হয়ে তাদের দাবির অনুকূলে সেখানে সমবেত কয়েকজনকে নিজের হাতে পানি পান করিয়েছেন। কাজী জাফর ও এরশাদের কতিপয় সহচর জাতীয় পার্টি থেকে হেফাজতে ইসলামের ঐ সব দাবিকে এবং তা আদায়করণের জন্য শাপলা চত্বরের পরিকল্পিত সমাবেশ তার দলের তরফ থেকে সমর্থন করা হচ্ছে বলে জানিয়ে দেন। খালেদা জিয়াও তার অনুসারীদের মাধ্যমে হেফাজতীদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং সন্দেহাতীত অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে বলে পাঠান যে, ৫ মে’র পর ঢাকা তার কথায় জনগণের হাতে চলে যাবে এবং হেফাজতীদেরসহ তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পুনঃনির্বাচন অনুষ্ঠিত করে গণতন্ত্রকে জয়ী করবেন। তার তরফ থেকে তিনি তাদের প্রবীণ নেতা এম, কে আনোয়ারকে সমাবেশস্থলে পাঠান এবং জানিয়ে দেন যে সময়ান্তরে তিনি নিজে শাপলা চত্বরে হেফাজতীদের সঙ্গে মিলিত হবেন। ক্ষমতার লোভে এ সব নেতা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কতটুকু নিচে নামতে পারেন তা শুনে ও দেখে আমি এদেরকে জনস্বার্থের বিরোধী বলে সর্বাত্মক মাত্রায় প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি এরশাদ ও খালেদা জিয়াকে এই সমাবেশ থেকে দূরে রাখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেই। এই নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরকে সাবধান করে দেয়ার ফলে এই সমাবেশে তারা যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু লোক এবং মোবাইল ফোন মারফত তারা সমাবেশের নেতা ও চেলাদের সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন এবং কোন কারণেই যেন মাওলানা শফী সমাবেশ থেকে দূরে না থাকেন ও সেদিন ৬টার সময় সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা না করেন, খালেদা জিয়ার আল্টিমেটাম সমর্থনে সমাবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যাহত রাখেন তার জন্য পরামর্শ দেন। গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ধর্মান্ধ ও স্বার্থান্বেষী সন্ত্রাসীদের বিএনপি ও জামায়াত নেতারা একই মর্মে নির্দেশ দেন। মাওলানা শফীকে মোবাইল ফোনে খালেদা জিয়া নিজে সরাসরি এই মর্মে অনুরোধ জানান জেনে আমি স্তম্ভিত হই। বেলা ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা হেফাজত কর্মীদের একটি দল বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেট থেকে জিপিওর পূর্বদিকের সড়ক ধরে একই মসজিদের উত্তর গেটে এসে পুলিশের সঙ্গে ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা, লোহার রড ও ধারাল অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষ শুরু করে। তারা পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং আশপাশের নিরীহ জনগণের ওপর ধারালো অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়তে থাকে। এর পর থেকে এই এলাকায় দফায় দফায় হেফাজতীদের সঙ্গে পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই সংঘর্ষ এক পর্যায়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ ফটক ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, মতিঝিল, দৈনিক বাংলার মোড়, নূর হোসেন চত্বর ও বিজয়নগর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের সময় জনগণকে উত্তেজিত করার কপট উদ্দেশ্য নিয়ে হেফজত কর্মীরা তাদের নেতাদের নির্দেশে বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পার্শ্বস্থ ধর্মগ্রন্থের দোকানগুলো লুট করে ও সেখানে রক্ষিত জায়নামাজ ও কোরআন শরীফে অগ্নিসংযোগ করে। একই সময় তাদের একটি দল দোতলায় উঠে সোনার দোকানগুলো ভাংচুর ও লুট করে। এখানে ফায়ার বিগ্রেডের অগ্নিনির্বাপণের গাড়িসমূহকে যেতে ও কাজ করতে ছাত্রশিবিরের সদস্যগণসহ হেফাজতীরা বাধা দেয়। ফলত তাদের সঙ্গে দোকানি ও সাধারণ জনগণের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। খবর আসে যে, এই সংঘর্ষে প্রায় ১০০ জন সাধারণ পথচারী ও দোকান মালিক-কর্মচারী আহত হন এবং ২ জন হেফাজতী সন্ত্রাসী দোকান মালিক ও কর্মচারীদের প্রতিরোধে মারা যায়। এদের লাশ হেফাজতীরা পরে এসব দোকান থেকে লুট করা কাফনের কাপড়ে মুড়ে শাপলা চত্বরে নিয়ে যায়। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে হেফাজতীরা গোলাপ শাহ মাজারের কাছে ২০টি গাড়ি ভাংচুর করে। এখানেও আমজনতার সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব সংঘর্ষের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাদের ধাওয়া করেন। হেফাজত কর্মীরা পিছনে হটে গিয়ে আবার হকি স্টেডিয়ামের দিক থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের দিকে আসতে চেষ্টা করে। তখন পুলিশ ও র‌্যাব জলকামান এবং এপিসিসহ এগিয়ে এসে তাদের হটিয়ে দেয়। এদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সকাল থেকে বিজিবি গোটা দশেক প্লাটুন নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের পশ্চিমে কদম ফুল ফোয়ারার উত্তর দিকে এবং সুপ্রীমকোর্টের মূল গেটের সামনে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে অবস্থান করে আসছিল। নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, একবারে প্রয়োজন না হলে বিজিবি পুলিশের সঙ্গে একত্রিত হয়ে প্রত্যক্ষভাবে হেফাজতীদের দমনে শক্তি প্রয়োগ করবে না। বেশ সংখ্যক হেফাজত কর্মী এরপর গুলিস্তান সংলগ্ন ও ফুলবাড়িয়া এলাকায় সমবেত হয়। বেলা ২টা ৩০ মিনিটের দিকে হেফাজতের একটি বড় মিছিল বংশাল সড়ক হয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে আসতে চেষ্টা করে। তারা গোলাপ শাহ মাজারের দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও বোমা ফাটিয়ে আতঙ্কময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাদেরকে দমন করার জন্য বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটের দিকে পুলিশ ও র‌্যাব বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, নূর হোসেন চত্বর, পল্টন ও জাতীয় প্রেসক্লাব সংলগ্ন সড়কে অবস্থান দৃঢ়তর করে। তখন হেফাজতীরা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও উত্তর গেট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পূর্ব দিক ও বিজয়নগর সড়কে অবস্থান নেয়। তাদের ঠেকাতে পুলিশ ও র‌্যাব বিরতিহীনভাবে লাঠি, শটগান, কাঁদান গ্যাস ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। বিকেল ৪টার দিকে শাপলা চত্বরে সমাবেশমুখী হেফাজত কর্মীরা পুরানা পল্টনস্থ কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয় মুক্তি ভবনে হামলা চালায় এবং সেখানে ফুটপাথের দরিদ্র দোকানিদের দোকানগুলোতে আগুন দেয়া ও ঐ ভবনের নিচতলায় অবস্থিত অন্যান্য দোকানপাট ভাংচুর ও লুট করে। ফলত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও সেখানে আশ্রয় নেয়া বিভিন্ন সংবাদপত্রের সংবাদকর্মী এবং আশপাশের কয়েকশ’ ভবনের লোকজন অবরুদ্ধ হয়ে যান। রাত ৮টা পর্যন্ত এই অবরুদ্ধ এলাকা থেকে কোন অফিস কর্মী বা ক্রেতা বা দোকানি বেরুতে পারেননি। একই সময় হেফাজত কর্মীরা বংশাল সড়ক, হকি স্টেডিয়াম, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও উত্তর গেট থেকে আবারও বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের দিকে আসার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় হেফাজতের কর্মী ও সমর্থকরা আশপাশের ভবনসমূহের ছাদে উঠে অবস্থান নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে অসংখ্য বোমা ও ককটেল ছোঁড়ে। এ সময় হেফাজতীদের হামলায় নাহিদ শিকদার নামে এক পথচারী এবং সিদ্দিক নামে একজন মোটর শ্রমিক মারা যান। সন্ধ্যায় ধর্মান্ধরা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণে ফুটপাথে অবস্থিত ছোট ছোট দোকানের কাঠের কাঠামোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর আগে তারা ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনারের বিজয়নগরস্থ কার্যালয়ে আগুন দেয়। এতে গুরুতরভাবে আহত হন কনস্টেবল পেয়ারুল ইসলাম। ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার ইকবাল হোসেনের রিপোর্ট অনুযায়ী তার কার্যালয়ের নিচতলা ও দোতলার ৭টি কক্ষ হেফাজতীদের আগুনে পুড়ে যায়। এ সময় দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপক কামাল উদ্দিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আগের সিদ্ধান্ত আনুযায়ী বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। বেলা ৪টা থেকে হেফাজত কর্মীরা দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে বিভিন্ন সড়ক ধরে সমাবেশে জড়ো হওয়ার জন্য এগিয়ে আসে এবং তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত বা অনুকল্পিত অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হতে থাকে। এসব এলাকায় একই সঙ্গে চলতে থাকে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে মাইকযোগে হেফাজতের ঐসব নেতাকর্মীকে শাপলা চত্বর ছেড়ে দেয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু হেফাজতীদের তরফ থেকে জানানো হয় যে, তারা সেখানেই অবস্থান করবে। তারা নগরের বিভিন্ন মসজিদে তাদের সমর্থনে কমিটি গঠনের ঘোষণা দিতে থাকে। একই সময় তারা প্রচার করে যে, হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের পাশে সকল ঢাকাবাসীকে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। তার তরফ থেকে তার উপদেষ্টা ও সহযোগী এম, কে আনোয়ার এবং শামসুজ্জামান দুদু এই আহ্বান প্রচার করেন বলে জানা যায়। এই আহ্বানের সঙ্গে থেকে থেকে এও প্রচার করা হয় যে, তারা বিএনপির তরফ হতে হেফাজতীদের সমর্থনে এবং তাদের ভাষায় গণতন্ত্র স্থাপনে খালেদা জিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের পদত্যাগ ইতোমধ্যেই দাবি করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে সন্ধ্যার আগে লাখখানেক হেফাজত কর্মী সমবেত হয়েছিল। চত্বরের পশ্চিমে ২টি ট্রাকের পেছনের ডালা খুলে একটির সঙ্গে আরেকটি লাগিয়ে দিয়ে তারা একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল। এই মঞ্চের পাশে তারা কাপড়ে মোড়া ২টি লাশ রেখেছিল। এই দুটি লাশ হেফাজতীরা বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে নিয়ে এসেছিল বলে জানা যায়। এ দু’জন বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম দিকের দোকানগুলো লুট করার সময় দোকানিদের হাতে নিহত হয় বলে জানা যায়। একটি লাশ জোবায়ের নামে এক কর্মীর বলে হেফাজতীদের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ঘোষণায় বলা হয়েছিল যে, তখন থেকে তারা শাপলা চত্বরকে শহীদ জোবায়ের চত্বর বলে নামকরণ করবে।
×