ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তথ্যমন্ত্রী

পদত্যাগ করেই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৫ আগস্ট ২০১৭

পদত্যাগ করেই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে নিজেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি পদত্যাগ করে এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেন। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন জাসদ সভাপতি ইনু। তথ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজেই বিতর্কের সূচনা করেছেন, সরকার করেনি। তিনি একটি বিতর্কিত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছেন এবং একটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। বিতর্কের সূচনা করে তিনি জনমনে নিজেকে এবং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে একটি বিতর্কিত অবস্থানে নিয়ে গেছেন। প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই পদ থেকে পদত্যাগ করে এই বিভ্রান্তির অবসান ঘটাতে পারেন; বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি পুনঃস্থাপনে সাহায্য করতে পারেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ষোড়শ সংশোধনীতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে আনা পরিবর্তন অবৈধ ঘোষণা করে আপীল বিভাগের দেয়া রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা শুরু হয়। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে এস কে সিনহা জাতীয় সংসদ ও বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেছেন অভিযোগ তুলে ক্ষুব্ধ সরকারী দলের নেতারা রায়ের কড়া সমালোচনা করছেন। বাক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সিনহাও। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান আমলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে ঐতিহাসিক অভিহিত করে ক্ষমতাসীনদের পাল্টা সমালোচনায় রয়েছে বিএনপি। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের উদ্দেশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয় মন্তব্য করে সংবাদ সম্মেলনে জাসদ নেতা ইনু বলেন, এটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বকে বিতর্কিত করা ও সামরিক শাসনের জঞ্জালকে পুনরায় টেনে আনার অপপ্রয়াসমূলক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিদ্বেষমূলক। রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অধিকার স্বীকৃত মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, রায়ের পরও রাজনৈতিক উসকানিমূলক বক্তব্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে বলেই রায় নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মাত্রা কিছুটা তীব্র। পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে এনে উনি (প্রধান বিচারপতি) নিজেই উত্তেজনা বাড়িয়েছেন। তবে এ রায় কোন সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেনি, সরকার ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখিও করেনি। এ রায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও কিছু নেই। সরকার পরিচালনায় কোন প্রভাবও ফেলবে না, কোন অচলাবস্থাও তৈরি হবে না। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে উল্লসিত হয়ে মিষ্টি বিতরণকারীরা চক্রান্তের রাজনীতির পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেন জাসদ একাংশের এই সভাপতি। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রায় যুক্তিনির্ভর নয় দাবি করে ইনু বলেন, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলও ত্রুটিমুক্ত নয়। আমরা বিচারপতি অপসারণের তিন স্তর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বিচারপতিদের বিষয়ে অভিযোগের সকল তদন্ত অন্য কেউ নয়, বিচারপতিদের কমিটিই করবেন। সংসদ সেই তদন্ত পর্যবেক্ষণ করবে এবং রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু রায়ে এক স্তর অর্থাৎ, সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলই বহাল রাখা হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, যে সকল বিচারপতি অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন, জাল সার্টিফিকেট দিয়েছেন, দুর্নীতি করেছেন, আজ পর্যন্ত তাদের বিষয়ে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কোন ব্যবস্থা নেয়নি। রায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে জানিয়ে ইনু বলেন, কীভাবে আইনী প্রক্রিয়ায় অপ্রাসঙ্গিক সকল পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারসহ রায় পুনর্বিবেচনা করা যায়, তা দেখা হচ্ছে। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিও ভূমিকা রাখতে পারেন। সংসদ রায়ের ওপর আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, আদালতের বারান্দায় কোন বিচারপতির রায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গে খ-িত-বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক কোন রায়ের নামে ইতিহাসের ভ্রান্ত চর্চার মাধ্যমে জাতির ইতিহাস বিকৃতিও ঘটানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশ তার নিজস্ব পথেই চলবে। রায়ে দেয়া পর্যবেক্ষণ রায়ের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি নিজস্ব বক্তব্যকে রায়ের অংশ বানিয়ে ফেলেছেন। নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা বিচার বিভাগেরও দায়িত্ব। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে রায়ের উদ্দেশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয়, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বকে বিতর্কিত ও সামরিক শাসনের জঞ্জালকে রক্ষা করা ও রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলকÑসুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলও ত্রুটিমুক্ত নয়। এ রায়, কোন সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেনি, সরকার ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখিও করেনি। এ রায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও কিছু নেই। সরকার পরিচালনায় কোন প্রভাবও ফেলবে না, কোন অচলাবস্থাও তৈরি হবে না। সরকার নয়, রায়ের বিষয়বহির্ভূত পর্যবেক্ষণ ও রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে প্রধান বিচারপতিই বিতর্কের সূচনা করেছেন। রায় যুক্তিনির্ভর নয়, অগ্রহণযোগ্য, পুনর্বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়টি সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় বিধায় এ সম্পর্কে দু’একটি কথা বলার জন্য আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ক রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের উদ্দেশ্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নয়, এটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বকে বিতর্কিত করা ও সামরিক শাসনের জঞ্জালকে পুনরায় টেনে আনার অপপ্রয়াসমূলক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও বিদ্বেষমূলক। ১৯৭২ সালের সংবিধান আমাদের মূল সংবিধান। এই মূল সংবিধানের ওপরই পরবর্তীতে অনেকবার হাত দেয়া হয়। বিশেষ করে সামরিক শাসন আমলে একে কাটছাঁট ও বহু অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামরিক শাসনের চাপিয়ে দেয়া আবর্জনা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করা শুরু হয়। তারই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ সংশোধনী-সবই মূল সংবিধানে ফেরত যাওয়ার জন্যই। এই ষোড়শ সংশোধনীও মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনেরই আরেকটি পদক্ষেপ। কার্যত এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার নতুন কোন বিধান নয়, মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের একটি বিধান মাত্র। শুধু এবারই প্রথম মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদ বাদ দিয়ে সামরিক শাসনের অনুচ্ছেদ গ্রহণ করার রায় হলোÑএ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অধিকার স্বীকৃত। রায়ের পরও রাজনৈতিক উসকানিমূলক বক্তব্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে বলেই রায় দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মাত্রা কিছুটা তীব্র। পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে এনে উনি নিজেই উত্তেজনা বাড়িয়েছেন। তবে এ রায়, কোন সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেনি, সরকার ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখিও করেনি। এ রায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও কিছু নেই। সরকার পরিচালনায় কোন প্রভাবও ফেলবে না, কোন অচলাবস্থাও তৈরি হবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এক বিষয়, আর দায়বদ্ধতা আরেক বিষয়। বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি দায়বদ্ধতার সঙ্গে জড়িত। সুতরাং ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান প্রদত্ত বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার ওপর কোন হস্তক্ষেপ নয়, মূল সংবিধান অনুযায়ী দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া মাত্র। অধস্তন আদালতের বিচারকের অপসারণ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে এ রায় এ ব্যাপারে রহস্যজনক নীরবতা পালন করেছে, শুধু উচ্চতর আদালতের বিচারকদের কথাই বলেছে। মনে রাখতে হবে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে এই, বিচার কাজ ও প্রক্রিয়ায় সরকার বা বাইরের কোন হস্তক্ষেপ বা প্রভাব না ঘটা। সংবিধান প্রদত্ত এই স্বাধীনতা সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। এ রায়ের পর থেকে আপীল নিস্পত্তি পর্যন্ত সরকারের কেউই এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের ব্যক্তিবর্গের রায় সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ সরকারকে বিচার বিভাগের মুখোমুখি দাঁড়ও করায়নি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও ক্ষুণœ হয়নি। এ রায়ে যারা উল্লসিত হয়ে মিষ্টি বিতরণ করছেন এবং কাল্পনিক সাংঘর্ষিক অবস্থা খুঁজে পাচ্ছেন তারা মূলত চক্রান্তের রাজনীতির পাঁয়তারা করছেন। তিনি বলেন, সরকার রায়ের জায়গাটুকু ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি বা রায়ের প্রক্রিয়া কোন হস্তক্ষেপও করেনি। রায়ের বিষয়বহির্ভূত প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, তা-ই বির্তকে সূচনা করেছে, সরকার কোন বিতর্কের সূচনা করেনি। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের ব্যক্তিবর্গ প্রধান বিচারপতির অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের উত্তর দিয়েছেন মাত্র। ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে হাইকোর্টের যে সার্টিফাইড রায় সুপ্রীমকোর্টে উপস্থাপন করা হয়, সেখানে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ, সংসদের ক্ষমতা, দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানাদিসহ যে বিষয়গুলোর উল্লেখ নেই, সেই বিষয়গুলো টেনে এনে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিভ্রান্তিকর। তিনি সংসদকে খাটো করেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করেছেন। মনে রাখতে হবে, রায়ের ভেতরে দেয়া পর্যবেক্ষণ রায়ের অংশ হিসেবেই পরিগণিত হয়। প্রধান বিচারপতি নিজস্ব বক্তব্যকে রায়ের অংশ বানিয়ে ফেলেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ যথা, নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগÑএই অংশগুলোর মর্যাদা রক্ষা বিচার বিভাগেরও দায়িত্ব। এ অঙ্গগুলো সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করে তিনি তাদের বিতর্কিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু রেওয়াজ হলো, যাদের বিরুদ্ধে তিনি তির্যক মন্তব্য করতে চান, সেই অঙ্গগুলোর বক্তব্যও তাকে আগে শুনতে হয়। বিচারপতিদের শপথ অনুসারে কোন অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হওয়া চলে না। আমাদের দেখতে হবেÑরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করলে তাতে শপথ ভঙ্গ হয় কিনা? তিনি সংসদকে কোন নির্দেশ দিতে পারেন কিনা? রায় পর্যবেক্ষণে ’৭১-এর শান্তি কমিটি দিনের রাজাকারি ও রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারীÑএই মন্তব্য দিয়ে তিনি রাজাকারদের হালাল করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফাঁদ পাতছেন কিনা? সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে সুপ্রীমকোর্টের রায় অধস্তন আদালতের অবশ্যই পালনীয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ হাইকোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ কি সেই বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত বা প্রভাবান্বিত করল না? লিখিত বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এ রায় যুক্তিনির্ভর নয়, অগ্রহণযোগ্য। সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলও ত্রুটিমুক্ত নয়। বিচারপতি অপসারণের তিন স্তর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বিচারপতিদের বিষয়ে অভিযোগের সকল তদন্ত অন্য কেউ নয় বিচারপতিদের কমিটিই করবেন। সংসদ সেই তদন্তে পর্যবেক্ষণ করবে এবং রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু রায়ে এক স্তর অর্থাৎ সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলই বহাল রাখা হয়েছে। যে সকল বিচারপতিরা অবৈধ সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন, জাল সার্টিফিকেট দিয়েছেন, দুর্নীতি করেছেন, আজ পর্যন্ত তাদের বিষয়ে সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কোন ব্যবস্থা নেয়নি। মূল সংবিধানের ৯৪(৪) অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে দেয়া ছিল। তখন ১১৬(ক) এ বর্ণিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়নি। এখন কেন তা ক্ষুণœ হয়েছে বলে রায় দেয়া হলো? ১৯৭২ সংসদ পরিপক্ব ও কার্যকর ছিল। এখন সংসদ অপরিপক্ব ও অকার্যকর বলা হচ্ছেÑকোন মাপকাঠিতে? পরিপক্বতা ও কার্যকারিতার সংজ্ঞা কি? মূল সংবিধানের কি রিভিউ হয়? রায় পর্যবেক্ষণের ২৪৬ পাতায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বিচারপতিদের জবাবদিহিতা উচ্চতর আদালতে, মানুষের কাছে, গণমাধ্যম, গবেষণাকারী, একাডেমিশিয়ানদের কাছে। তাহলে সবার কাছেই জবাবদিহিতা, কেবলমাত্র সংসদের কাছেই নয়? কেন? দেখুন, বিচারপতিদের নিয়োগ দেয় জনগণ, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। তাদের জবাবদিহিতাও তাই জনগণের কাছেই থাকা উচিত। আর জনগণের প্রতিনিধি হচ্ছে সংসদ। তাহলে সংসদে জবাবদিহিতা করতে বাধা কোথায়? প্রধান বিচারপতি বলেছেন, রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, ব্যবসায়ীরা সংসদে। কোথায় লেখা আছে ব্যবসায়ীরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন না? স্বাস্থ্য খাত খারাপ, প্রশাসন নিম্নমানের কাজ করে, অবাধ দুর্নীতি চলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ। আমি তো দেখছি, জঙ্গী দমনে আমরা সফল হচ্ছি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জনসেবা-প্রশাসনের মান বাড়ছে। তিনি ঝেড়ে সব খারাপ বলছেন, ব্যাখ্যা দেননি। কোন কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই ঢালাও মন্তব্য করেছেনÑতা বলেননি বা রাষ্ট্রের কোন অঙ্গ সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করলে তাদের মন্তব্যও নিতে হয়, তা নেননি। প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতির ভিন্ন ভিন্ন মত আছে, পর্যবেক্ষণ আছে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অনুসরণীয় কর্তব্য। তাহলে কোন অংশ ব্যক্তিগত মতামত আর কোন অংশ অনুসরণীয় কর্তব্য হবে? তথ্যমন্ত্রী বলেন, রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করছি, কিভাবে একে আইনী প্রক্রিয়ায় অপ্রাসঙ্গিক সকল পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারসহ রায় পুনর্বিবেচনা করা যায়। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিও ভূমিকা রাখতে পারেন। সংসদ রায়ের ওপর আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারে। প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা, তাও বিচার্য। প্রধান বিচারপতি যেখানে নিজেই অনভিপ্রেত মন্তব্য দিয়ে বিতর্কের সূচনা করে জনমনে নিজেকে এবং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে একটি বিতর্কিত অবস্থানে নিয়ে গেছেন, এই ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তিনি নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের অবসান ও বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখবেন কিনা তাকে ভেবে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি। আদালতের বারান্দায় কোন বিচারপতি রায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রসঙ্গে খ-িত-বিকৃত-উদ্দেশ্যমূলক কোন রায়ের নামে ইতিহাসের ভ্রান্তচর্চার মাধ্যমে জাতির ইতিহাস বিকৃতিও ঘটানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশ তার নিজস্ব পথেই চলবে।
×