ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীতে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন মানোন্নয়ন শীর্ষক বিভাগীয় কর্মশালা

ব্রুনাইয়ে নির্যাতনের শিকার পাঁচ যুবকের করুণ কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৫ আগস্ট ২০১৭

ব্রুনাইয়ে নির্যাতনের শিকার পাঁচ যুবকের করুণ কাহিনী

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ভাল বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাগমারার পাঁচ যুবককে ব্রুনাইয়ে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। কাজ না পেয়ে প্রতারিত হয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন তারা। প্রতারিত ওইসব যুবক টাকা ফেরত ও নির্যাতনের বিচার চেয়ে ব্রুনাই প্রবাসী এক প্রতারক, তার পিতা ও চাচাত ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় আলাদা আলাদা অভিযোগ দিয়েছেন। বুধবার রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ইউরোপিয়ন ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও ব্র্যাকের উদ্যোগে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন মানোন্নয়ন শীর্ষক বিভাগীয় কর্মশালায় তাদের করুণ চিত্র উপস্থাপন করা হয়। এ কর্মশালায় রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার নূর উর রহমান, জেলা প্রশাসন হেলাল মাহমুদ শরীফ ও রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মাসুদুর রহমান ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় প্রতারিতরা নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। প্রতারকের খপ্পরে পড়ে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বলে জানান তারা। প্রতারিতদের ভাষ্য, উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের বাঙ্গালপাড়া গ্রামের আবেদ আলীর ছেলে ব্রুনাই প্রবাসী আসাদুল ইসলাম এলাকার পাঁচ যুবককে ভাল চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সে দেশে নিয়ে যান। এরা হলেনÑ উপজেলার সাদোপাড়া গ্রামের রহিদুল ইসলাম (৩০), মথুরাপুরের সোনাবুল রানা (২৭), বাঙ্গালপাড়ার প্রশান্ত কুমার (২৪), নিমপাড়ার মামুন হোসেন (২৬) ও যাত্রাগাছির ভুট্টু হোসেন (২৬)। প্রত্যেককে সাড়ে চার লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। আসাদুল ইসলামের পক্ষে তার চাচাত ভাই আশরাফুল ইসলাম ও বাবা আবেদ আলী টাকা গ্রহণ করেন। প্রতারিত যুবকদের মধ্যে জুলাই মাসে তিনজন এবং গত ২ আগস্ট দুইজন দেশে ফিরেছেন। বাড়ি থেকে বিমান ভাড়ার টাকা পাঠানোর পর তারা দেশে ফেরেন। প্রতারিত যুবকর রহিদুল, সোনবুল ও প্রশাস্ত সাহা বলেন, গত মার্চ মাস থেকে মে মাসের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ ভিসায় তাদের ব্রুনাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দেশের বিমানবন্দর থেকে আসাদুল ইসলাম তাদের গ্রহণ করে সালামদিঘা শহরের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে আরও বাংলাদেশী যুবক রয়েছেন। সেখানে যাওয়ার পর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হন। তারা বলেন, কোন কাজ বা খাবার না দিয়ে একটি ঘরে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। সপ্তাহে দু-একদিন খাবার দেয়া হয়। অন্য সময়ে তারা পাহাড় থেকে লতাপাতা সংগ্রহ করে তা সেদ্ধ করে এবং ওই এলাকার বাঙালীদের কাছ থেকে চেয়ে খেয়েছেন। খাবার চাইলে এবং কাজ চাইলে তাদের হাতুড়ি দিয়ে হাত ও পা থেঁতলে দেয়া হয়। শরীর ও হাতের ক্ষত চিহ্ন দেখিয়ে প্রশান্ত কুমার বলেন, তাদের ওই ভাড়া বাড়িতে রেখে প্রতারক আসাদুল ব্রার্গাস শহরের আরেকটি বাড়িতে থাকতেন। মাঝেমধ্যে এসে তাদের খাবার কিনে দিতেন। তবে তা দুদিনের বেশি চলত না। খাবার চাইলেও তার লোকজন দিয়ে পেটানো হতো। এ সময় ওই ঘরে থাকা সাতজনই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শরীরে চর্ম রোগ দেখা দেয়। আরেকজন সোনাবুল রানা বলেন, জমি-জমা বিক্রি ও ঋণ করে সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়ে আসাদুলের মাধ্যমে ব্রুনাইয়ে গিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, বাড়িতে এসব কথা জানানোর ভয় দেখালে তাদের হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে মেরে লঙ্কানের (ড্রেন) ভেতরে ফেলে দেয়ার হুমকি দিত। তিনি জানান, প্রতারক আসাদুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণে বাগমারা, নাটোর ও পুঠিয়া এলাকার মোট ২৮ জন রয়েছেন সেখানে। তারা দেশে ফিরতে পারলেও অন্যরা পারছেন না। শ্রীপুর গ্রামের আজগর আলী জানান, তার ছেলেকেও আসাদুল ব্রুনাইয়ে নিয়ে গিয়ে কাজ দেয়নি। টাকার অভাবে ছেলেকে দেশে আনতে পারছেন না। বাঙ্গালপাড়া গ্রামের জেলে গোপাল হালদার বলেন, প্রতারক আসাদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ব্রুনাইয়ে আছেন। আট মাস আগে দেশে এসে তাদের জানিয়েছেন ওই দেশের একটি কোম্পানির সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। সেখানে ভাল বেতনে চাকরি দেয়া হবে। তার কথায় বিশ^াস করে ছেলেকে পাঠিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে প্রতারক প্রবাসী আসাদুল ইসলামের চাচাত ভাই, আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আসাদুলের বাবা আবেদ আলী বলেন, তার ছেলে অনেক দিন ধরে বিদেশে আছে। যাদের পাঠিয়েছিল, তাদের ভাল চাকরি দেয়া হয়েছিল। তবে টাকা সব ওই কোম্পানির লোকের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান। বাগমারা থানার ওসি নাছিম আহমেদ প্রতারিত তিনজনের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, সবাইকে ভ্রমণ ভিসায় পাঠানো হয়েছিল।যাদের পাঠানো হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই প্রতারক আসাদুল ইসলামের আত্মীয়। এদিকে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকা বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সরাসরি এসব বর্ণনা শুনেন। বিভাগীয় কমিশনার নুর উর রহমান বলেন, অভিবাসন নিয়ে এখন বড় সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এটি বড় ধরনের হুমকি। এখন সচেতন হওয়ার সময় এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কর্মশালায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার প্রজেক্ট সাপোর্ট অফিসার প্রাভিনা গুরুঞ্জ ও জেলা ব্র্যাক প্রতিনিধি একেএম জাহেদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
×