ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৫ আগস্ট ২০১৭

বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

হাতের কাছে অনেক খবর। সব খবরই অর্থনীতির ওপর, আছে বন্যার খবরও। একটি খবরে বলা হচ্ছে- বাণিজ্য ঘাটতি ৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্য একটি খবরে বলা হয়েছে- বেসরকারী ব্যাংকে ঋণ খেলাপী বাড়ছে। চাকরিজীবীদের জন্য একটি খারাপ খবর আছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মানুষের চাকরি যাচ্ছে। এদিকে অন্য একটি খবরে বলা হচ্ছে- ব্যাংক-আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ছে। বন্যার একটি খবরে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। আমার মনে হয় বন্যার খবরটি আলোচনা করা দরকার আগে। দেখা যাচ্ছে ২২ আগস্টের খবর অনুযায়ী গত দশ দিনে মারা গেছেন ১২১ জন। নিখোঁজ আছে ৫ জন। ৬ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ৪০৩ কিলোমিটার। ২৬৮টি সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত। বাঁধ আংশিক ভেঙ্গে গেছে ৯৬টি। এসবই সরকারী তথ্য। এই খবর দিয়ে বন্যার ধ্বংসযজ্ঞের পুরো চিত্র পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। কোরবানির আগের এই বন্যাটি ভয়াবহ। এই বন্যায় এ পর্যন্ত ৪০টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে গত বাজেট মৌসুমে হওয়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সীমিত অঞ্চল। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এসব এক ফসলি জমির দেশ। এ কারণে ২-৩ মাস পূর্বের অকাল বন্যা প্রচ- ক্ষতি করে গেছে লাখ লাখ লোকের। সরকারী তথ্যেই বলা হয়েছে ৬ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য এই বন্যায় নষ্ট হয়েছে। কিন্তু এর ফল খুবই খারাপ। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী এই সুযোগে চালের দাম বাজারে চড়িয়ে একটা সঙ্কটাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করে। সরকারের ত্বরিত ব্যবস্থার ফলে চালের সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি হয়নি, যদিও চালের মূল্য এখনও কিছুটা অস্থিতিশীলতা রয়ে গেছে। অকাল বন্যার এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই এবার এসেছে ভয়াবহ বন্যা, যার খবর আমরা গত দুই সপ্তাহ ধরে কাগজে পড়ছি। সারা উত্তরবঙ্গ এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গে বন্যার প্রকোপ কমছে, জল নিচের দিকে নামছে। মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যার জলে ভাসছে। কাগজে দেখলাম দিনাজপুরের কৃষকরা পুনরায় ঘরবাড়ি মেরামতে মনোযোগ দিয়েছেন। সরকারী সংস্থা, সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণের সাহায্যার্থে কাজ করে যাচ্ছে। আশার কথা কোন জায়গা থেকে মারাত্মক খারাপ কোন খবর পাওয়া যায়নি। বন্যা তো গেল বা যাচ্ছে কিন্তু যে পুনর্বাসনের কাজ এখন জরুরী হয়ে পড়েছে তার জন্য লাগবে বিপুল অর্থ। সাধারণভাবে মানুষজনই পুনর্বাসনের ব্যয় বহুলাংশে বহন করবে। সরকার সাহায্য-সমর্থন যোগাবে। কিন্তু সরকার এবার এ কাজ করতে গিয়ে বেশ চাপের মধ্যে পড়বে। কারণ এবারের বাজেট (২০১৭-১৮) শুরুই হয়েছে, রাজস্ব-অনিশ্চয়তা দিয়ে। শুরুতেই ২০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি। এমতাবস্থায় সরকার প্রচ- আর্থিক চাপের মধ্যে পড়বে। এদিকে সঙ্কট সৃষ্টি হবে ব্যাংকগুলোর জন্য। এতদিন সরকারী ব্যাংকের খারাপ খবর পড়তাম। এদের খেলাপী ঋণ বাড়ছে। কোনভাবেই খেলাপী ঋণ তাদের কমছে না। প্রতিদিন থাকত এ খবর। গত ২১ আগস্ট একটা দৈনিকে একটি খবর পড়লাম। এতে বলা হয়েছে- এখন বেসরকারী ব্যাংকের খেলাপী বাড়ছে। খবরটিতে ২০টি ব্যাংকের তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছেÑ খুবই খারাপ খরব। কারণ এই তালিকায় ভাল ভাল ব্যাংকের নামও আছে। আমি নামোল্লেখ করলাম না। দেখা যাচ্ছে ভাল ও মন্দ সব ধরনের বেসরকারী ব্যাংকেই খেলাপী ঋণ বাড়ছে। ঘটনাটি এখানে থেমে থাকলে হয়ত বুঝতাম। কিন্তু ৪০-৪৫টি জেলায় যে বন্যা হয়ে গেল তার বোঝা ব্যাংকগুলোকেও বহন করতে হবে। এখন সারাদেশের প্রায় সব জেলাতেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের ব্যবস্থা আছে। কৃষি ঋণ দেয়া আছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি ও ক্ষুদ্র এবং মাঝারি খাতের লাখ লাখ ঋণ গ্রহীতা কীভাবে তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে এটাই এখন ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তা। কৃষকদের দুটো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষেতে আউশ ফসল জলের তলে ছিল অকেনদিন। এদিকে সামনে আসছে আমন ফসল ও রোপার সময়। বন্যায় বীজতলা নষ্ট হয়েছে। চারা সব নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে চারা তৈরিতে সময় লাগবে বিধায় আমন ফসল বিলম্বিত হবে। অথচ আউশ-আমন মিলিয়ে প্রচুর খাদ্যশস্য পাওয়া যায়। এদিকে সরকারের গুদামে যথেষ্ট পরিমাণ চাল-খাদ্যশস্য নেই। অবশ্য আমদানি পুরাদমে চালু আছে। সরকার আমদানি করছে কম, বেসরকারী খাত বেশি। এই জায়গায় যাতে কোন সরবরাহ ঘাটতি না হয় তা দেখার দায়িত্ব সরকারের। এখানে সরকারের ভাবমূর্তি জড়িত। আশা করি সরকার এটা বোঝে। যে কথাটা বলছিলাম তা হচ্ছে খেলাপী ঋণ। বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কারণে ব্যবসায়ী ঋণ ও কৃষি ঋণে খেলাপীর পরিমাণ বাড়তে পারে। এদিকে আরেক সঙ্কট দেখা দিতে পারে ব্যাংক- আমানতে। আমি এ কথা বহু আগে থেকেই বলে আসছি দীর্ঘদিন আমানতের প্রবৃদ্ধি কম হলে এবং ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হলে একসময়ে ব্যাংকগুলোতে ‘ফান্ডের’ সঙ্কট হবে। এর মধ্যে যোগ হবে নতুন ঋণ খেলাপী। অর্থাৎ যে টাকা ফেরত আসার কথা ছিল সেই টাকা আসবে না। ফলে সমস্যা গভীরতর হবে। ইতোমধ্যে এই সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছে। একটি খবরে দেখলাম ৬টি বেসরকারী ব্যাংক তাদের সুদের হার বাড়িয়েছে যদিও বৃদ্ধির পরিমাণ খুবই কম। তবু এটা আশার লক্ষণ। আমানতকারীরা বর্তমানে কোন সুদ পাচ্ছে না। কারণ মূল্যস্ফীতির হার সুদের হারের তুলনায় বেশি। এমতাবস্থায় আমানতের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়াতে আমানতকারীরা একটু স্বস্তি পাওয়ার কথা। আমানত হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়। এটাই হওয়া উচিত পুঁজি গঠনের মাধ্যম। ভোগবাদিতা আজকাল সারা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। বলা হচ্ছে কীসের সঞ্চয়? ‘খাও, দাও, ফূর্তি কর’Ñ অর্থাৎ খরচ কর, ‘কনজামশন’ বাড়াওÑ তাহলেই হবে উন্নতি। এই ভোগবাদিতায় আমাদের সঞ্চয়াভ্যাস যাতে নষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্ব সরকারের। শত হোক বিপদে পড়লে মানুষকে সরকার সাহায্য করে না। চাকরি গেলে, অসুস্থ হলে, লেখাপড়ার জন্য সরকার কোন সাহায্য দেয় না। মানুষের ভরসা পরিবার ও পারিবারিক সঞ্চয় এবং সমাজ। এমতাবস্থায় সঞ্চয় কাঠামোটিকে ধরে রাখা দরকার। ব্যাংকগুলোকে অপচয় কমিয়ে খেলাপী ঋণ কমিয়ে বেশি সুদ দিতে উৎসাহিত করা দরকার। আরেকটি খারাপ খবরের কথা নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করেছি। আমরা জানতে পেরেছি আমদানি খুব বেশি বেশি হচ্ছে, সেই তুলনায় রফতানি বাড়ছে কম। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি)। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এই বৃদ্ধির কারণ কী তা তলিয়ে দেখা দরকার। বহুদিন ধরে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে নানাভাবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আমদানি-রফতানির কভারে দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। হঠাৎ করে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এভাবে বাড়ার পেছনে কী টাকা পাচারের ঘটনা দায়ী? যে কারণই থাকুক না কেন ঘটনা হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি এভাবে বাড়তে থাকলে টাকার মান অবমূল্যায়িত হবে। রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে যদিও এখন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ মোটামুটি সন্তোষজনক। আগস্টের ১৬ তারিখে এর পরিমাণ ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার ছিল বলে কাগজে দেখেছি। আমাদের ধারণা ছিল এই রিজার্ভের পরিমাণ যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে এটা সেইভাবে স্বস্তিজনক নয়। এমতাবস্তায় ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে তা হবে আত্মঘাতী। আমাদের শিল্প এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সব জিনিসের দাম বাড়বে। রফতানিযোগ্য পণ্যের দাম বাড়বে এতে রফতানির প্রতিযোগিতার ক্ষমতা নষ্ট হবে। অর্থাৎ বহুমুখী সমস্যার মধ্যে পড়ব আমরা। এমনিতেই অর্থনীতি চাপের মুখে। রাজস্ব ঘাটতি কীভাবে পুরিত হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়। এর মধ্যে রফতানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস, আমদানি প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা, ডলারের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধি, রেমিটেন্স হ্রাস ইত্যাদি অর্থনীতিকে আরও চাপের মধ্যে ফেলবে। বন্যাজনিত ক্ষতি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। এ কারণে সরকারের বহু খরচ বৃদ্ধি পাবে। খাদ্যশস্য আমদানিতে প্রচুর টাকা ব্যয় হবে। ঘোষণা মোতাবেক কয়েক লাখ লোককে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চাল দিতে হলে অনেক টাকা লাগবে। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। ঢাকার রাস্তার অবস্থাই খারাপ যেখানকার মধ্যবিত্ত সবসময়ই সরব। আর গ্রামের কথা কে বলবে। বলাইবাহুল্য রাস্তাঘাট মেরামত ও সংস্কারে এবার খরচ হবে প্রচুর টাকা। এ ছাড়া রয়েছে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ। লাখ লাখ মানুষ হয়েছে গৃহহারা তাদের ফসল নষ্ট হয়েছে। ঘরবাড়ি সব তলিয়ে গেছে। গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগি সবই গেছে। সামনে কোরবানির ঈদ। মানুষের দুই চোখে অন্ধকার। কীভাবে পবিত্র ঈদ উদযাপন করবে তারা। বসতবাড়ি মেরামতের কাজ করবে, না জমি চাষের গরু যোগাড় করবে, না খাবার যোগাড় করবে? অথচ এই সময়টা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মাত্র দ্বিতীয় মাস। বাকি রয়ে গেছে আরও ১০ মাস। ভবিষ্যত কী এই প্রশ্নই এখন বড়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×