ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্রুব হাসান

বিদায় নায়করাজ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৪ আগস্ট ২০১৭

বিদায় নায়করাজ

সময়টা ১৯৬৬ সাল ‘আখেরি স্টেশন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজ্জাক চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এর পর সালাউদ্দিন প্রোডাকশনসের ‘তের নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হন। নায়করাজ রাজ্জাক নামে সুপরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল আবদুর রাজ্জাক। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজা চলাকালে মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। তিনি ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান। প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামে ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। গত সোমবার বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কাঁদিয়ে গেলেন অগণিত ভক্তদের। নায়করাজের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে রাজ্জাক আবদুল জব্বার খানের সহযোগিতায় ইকবাল ফিল্মসে কাজ করার সুযোগ পান। পরিচালক কামাল আহমেদের সহকারী হিসেবে ‘উজালা’ ছবিতে কাজ শুরু করেন। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নাম্বার ফেকু অস্তাগড় লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তী সময়ে ‘কার বউ’, ‘ডাক বাবু’, ‘আখেরী স্টেশন’সহ আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। পরে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে সুচন্দার বিপরীতে তিনি নায়ক হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন এবং সবার মন জয় করে নেন। দর্শকের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি নায়করাজ উপাধি পান। রাজ্জাকের অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘আলোর মিছিল;, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘বাবা কেন চাকর’। নায়করাজ ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য। এরপর অশিক্ষিত (১৯৭৮), বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), যোগাযোগ (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে জন্য। ২০১১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। রাজ্জাক প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নায়করাজ শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও সফল। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র। সর্বশেষ তিনি ‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্রের বাইরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে কাজ করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক। রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে। তার প্রযোজনা সংস্থা রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি নির্মাণ করেছিলেন। এগুলো হলো-আকাক্সক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, আপনজন, মৌ চোর, বদনাম, সাত ভাই, চাঁপা ডাঙ্গার বৌ, জীনের বাদশা, ঢাকা-৮৬, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির প্রভৃতি। রাজ্জাক অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- সেøাগান, আমার জন্মভূমি, অতিথি, অমর প্রেম, যাদুর বাঁশী, অগ্নিশিখা, বন্ধু, কাপুরুষ, অশিক্ষিত, সখী তুমি কার, নাগিন, আনারকলি, লাইলী মজনু, লালু ভুলু, স্বাক্ষর, জজসাহেব, বাবা কেন চাকর, দেবর ভাবী, রাম রহিম জন, আদরের বোন, দরবার, সতীনের সংসার, কে তুমি, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, প্রিয়তমা, পলাতক, ঝড়ের পাখি, খেলাঘর, চোখের জলে, আলোর মিছিল, অবাক পৃথিবী, ভাইবোন, বাঁদী থেকে বেগম, সাধু শয়তান, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, মায়ার বাঁধন, গুণ্ডা, আগুন, মতিমহল প্রভৃতি। নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে চলচ্চিত্রসহ সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ভক্তরা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন ঠিক এইভাবে- মোস্তফা সরয়ার ফারুকী : তার নিজ ফেসবুক এ্যাকাউন্টে লিখেছেন, একটা যুগকে আপনি টেনে নিয়ে গেছেন। এখনো চোখে লেগে আছে ছোট বেলায় দেখা ‘ছুটির ঘণ্টা’! বিদায়, রাজ্জাক সাহেব। চিত্রনায়ক শাকিব খান তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টে লিখেছেন, বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক স্যার আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। অনন্ত জলিল লিখেছেন, রাজ্জাক আঙ্কেল আর আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন । কিছু মানুষের মৃত্যু হয় অমর হয়ে থাকার জন্য। নায়ক রাজ্জাক আঙ্কেল তেমনি একজন। মহান আল্লাহতায়ালা উনাকে বেহেস্ত নসিব করুন- আমিন। আমাদেরকে প্রতিদিন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। মনে করতে হবে আজকের নামাজই শেষ নামাজ, আজকের দিনই শেষ দিন। আর প্রতিদিন মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে। ইসতিয়াক আহমেদ নামে একজন তার ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস খুব নির্মম। যে লোক দেশ স্বাধীন করল, তিনি মারা গেলেন তার প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর গুলিতে। যে নারী শহীদ জননী, দীর্ঘসময় আন্দোলন করে গেলেন রাজাকার, আলবদরের বিরুদ্ধে। তিনি মারা গেলেন দেশদ্রোহের মামলা নিয়ে। রাজ্জাক, বাংলা চলচ্চিত্র চিনতে যাকে চিনি। তিনি মৃত্যুর আগে শুনে গেলেন, বাংলা চলচ্চিত্রে রাজ্জাকের কোন অবদান নেই। রাজ্জাক সাহেব, কষ্ট নিয়েন না। আপনি তো এটাও জেনে গেছেন আমরা এরকমই।’ সাংবাদিক দীপন নন্দী লিখেছেন, ‘রাজার মৃত্যু হয়েছে; রাজা বেঁচে আছেন’- নিজেদের রাজাদের নিয়ে এমনটাই ভাবেন ব্রিটিশ নাগরিকরা। আমাদের চলচ্চিত্রের ‘রাজা’ রাজ্জাক মারা গেছেন। তবে তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন কর্মের মাঝে। ‘জয়তু নায়করাজ।’
×