অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ছুরি, চাকু ও চাপাতি; দেশীয় অস্ত্রের ভয়ঙ্কর সব নাম। দেখলে গা শিউরে ওঠে। এমন দেশীয় অস্ত্রের আশপাশ দিয়ে কোন ভদ্রলোকের যাওয়ার কথা নয়; সারা বছর কেউ যানও না। কিন্তু সেই ভদ্রলোকেরাই এখন ধারালো ছুরির ধারে দিব্যি আঙ্গুল ঘঁষে নিচ্ছেন। পরখ করে কিনছেন ছোট ছুরি চায়নিজ কুড়াল ও চাপাতি। কারণ পবিত্র ঈদ-উল-আযহা ঘনিয়ে এসেছে।
ঈদ-উল-আযহার প্রধান আকর্ষণ কোরবানি। পশুর হাটও জমজমাট। তাই বরাবরের মতো মুখ্য বিবেচনা হয়ে উঠেছে গরু-ছাগল। সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা। তারপর কোরবানি। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ছুরি-চাপাতিসহ এসব উপকরণ খুবই জরুরী। পশু জবাই ও মাংস কাটার কাজটি সহজ করতে এসবের কোন বিকল্প নেই। কোরবানির পশু কেনার পাশাপাশি তাই চলছে ছুরি-চাকু কেনার কাজ। চাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রস্তুত কারিগররাও।
এ ধরনের উপকরণের বড়সড় সংগ্রহ রাজধানীর কাওরানবাজারের কামারপট্টিতে। এখানকার কামারশালায় কারিগররা এখন দারুণ ব্যস্ত। তপ্ত লোহা পিটিয়ে তৈরি করছেন ছুরি-চাকু-চাপাতি। বাজারে চাহিদাও প্রচুর। হাটে কোরবানির পশু যেমন বিকোচ্ছে, তেমনি জমে উঠেছে ছুরি-চাপাতির ব্যবসাও। তবে গত বছরের চেয়ে ছুরি-চাপাতির দাম এবার বেশ চড়া।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা ভাল হয়। তবে মূল কেনাকাটা এখনও শুরু হয়নি। রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এ বাজারে আছে প্রায় ৩৫টি কামারশালা। সেখানে ছুরি-চাপাতিসহ বিভিন্ন লৌহসামগ্রী বিক্রি হয়। বড় ও ভারি ভারি ছুরি বিশেষ কায়দায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সবকটি দোকান পাশাপাশি। যেখানে ছুরি চাপাতি আর দেশীয় অস্ত্রের সব সমাহার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছুরিটির নাম ‘জবাই ছুরি’। পশু জবাই করার জন্য বিশেষ উপযোগী করে বানানো। এটি ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চির মতো লম্বা। সামনের অংশ হাতির শুঁড়ের মতো বেঁকে কিছুটা উপরের দিকে ওঠে গেছে। শক্তভাবে ধরার জন্য রয়েছে কাঠের হাতল।
কেপিসি ট্রেডার্সের এক কারিগর আখতার হোসেন। তিনিসহ আরও তিনজন টগবগে তপ্ত লাল চাপাতিতে বাড়ি মারছিলেন আর কথা বলছিলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ৯ জন শ্রমিক আছেন। তারা ১৫-২০ দিন ধরে দা, বঁটি, ছুরি-চাপাতি, চাকু তৈরি করে যাচ্ছেন। কারওয়ান বাজার থেকে ঢাকার অন্যান্য এলাকার বাজারেও ছুরি-চাকু-বঁটির চালান যায়। তবে কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা ভাল হলেও এখনও মূল বেচাবিক্রি শুরু হয়নি বলে জানান তিনি।
কামারপট্টিতে চাকু দেখছিলেন হাবিবুর রহমান। কাওরানবাজারেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ঈদে গরু ছোলা-কোটার জন্য ছুরি ও চাপাতি কিনবেন তিনি। তাই আগে ভাগেই অর্ডার দিতে এসেছেন। তিনি বলেন, দাম একটু বেশি হলেও কিছুই করার নেই। বর্তমানে সব কিছুরই তো দাম চড়া। ঈদের সময় নতুন করে ছুরি-চাকু অথবা দা-বঁটি কিনতে হয়। তাই অর্ডার করতে এসেছি।
জনতা ট্রেডার্সের মোঃ সুজন জানান, জবাই ছুরির দাম মান অনুযায়ী ওঠানামা করে। তবে এখন ৩০০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। চামড়া ছাড়ানো ‘ছিলা ছুরি’র দাম ৬০-৩৫০ টাকা; মাংস সাইজ করার জন্য মাঝারি সাইজের ‘সাইজ ছুরি’র দাম ১০০ থেকে ৪০০ টাকা; চাপাতি (ভাল ৬০০-৮০০ টাকা; চাপাতি (নরমাল) ৩০০-৪০০; দা ১৫০-৫০০ টাকা; ভাল মানের বঁটি ৮০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি চায়নিজ কুড়াল ৫০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কাওরানবাজারের কামারপট্টি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি হারুনুর রশিদ বলেন, কোরবানির ওপর নির্ভর করে ছুরি-চাপাতির বিক্রির পরিমাণ ওঠানামা করে। এবার পশু কোরবানি যদি কম হয়, তবে তাদের পণ্যের বিক্রিও কম হবে। ছুরি-চাপাতির দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, প্রতি বছরই কয়লার দাম বাড়ছে। ফলে পণ্যের দামও বাড়ছে। এছাড়া এই শিল্পে প্রচুর শ্রম দিতে হয় বলে শ্রমিকের মজুরিও তুলনামূলক বেশি।
তবে এতসব ব্যস্ততা হুলস্থুলের মাঝেও একবার মনে করিয়ে দেয়া জরুরী, গরু ছাগল জবাই আর ভূরিভোজই কোরবানির উদ্দেশ্য নয়। কোরবানি মানে, মনের পশুকে কোরবানি করা।