ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভেনিজুয়েলা ॥ সামনে কঠিন পথ

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৩ আগস্ট ২০১৭

ভেনিজুয়েলা ॥ সামনে কঠিন পথ

‘ভেনিজুয়েলার জন্য এক নতুন দিনের শুরু আজ।’ নিকোলাস মাদুরো, ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপতি। ৩০ জুলাই আইনসভার নির্বাচনোত্তর তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন এভাবেই। যে আইনসভা হতে যাচ্ছে ভেনিজুয়েলার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। মাদুরোর এ ঘোষণার ঠিক পরদিন সাধারণ ভেনিজুয়েলানরা ধারণা পেয়ে গেছেন কেমন হতে যাচ্ছে মাদুরোর নতুন দিন। ঠিক পরদিন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সেবিয়ানের সদস্যরা দেশের প্রধান দুজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আটক করে তাদের। লিওপেল্ড লোপেজকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল জুলাইতে। বলা হচ্ছে তিনি ভেনিজুয়েলার সবচেয়ে বিখ্যাত রাজবন্দী। আশঙ্কা করছিলেন কারাবাসের। আর এর আগেই তিনি সাধারণ নাগরিকদের আহ্বান জানিয়ে একটি ভিডিও বার্তা প্রেরণ করেন। যার মূল আহ্বানÑ ‘ফাইট ফর ভেনিজুয়েল।’ যা ছড়িয়ে পড়েছে ভেনিজুয়েলাজুড়ে। এনটনিও লোপেজ কারাকাসের প্রাক্তন মেয়র। সরকারী এজেন্টরা যখন তাকে জোর করে গাড়িতে তোলেন তখনও ঠিকমতো ভাঙেনি তার ঘুম। কেউ একজন এই গ্রেফতারের ঘটনাটি ভিডিও করেন। যে ভিডিওতে নেপথ্য কণ্ঠে এক মহিলা বলছেনÑ ডিক্টেটরশিপ! বিরোধী দল, সাধারণ মানুষ, বিদেশী সরকার কেউই এটা বিশ্বাস করতে রাজি নন যে মাদুরোর সংসদ যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল। নির্বাচন কমিশনের ভাষায় ৫৪৫ জন সাংসদ নির্বাচনে ৮ মিলিয়ন ভোটারের ভোট প্রদানের যে তথ্য, তা নিতান্ত হাস্যকর। বেশিরভাগের বিশ্বাস তারা মাদুরোর অনুগত। এই অনুগত সংসদ নতুন করে সংবিধান রচনা, নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া থেকে সরকারের যে কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মাদুরোর ওপর। তার নাম উঠে এসেছে কিম জং উন, বাশার আল-আসাদ আর রবার্ট মুগারের সঙ্গে। যাদের ওপর কেবল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞাই নেই তাদের সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। ভেনিজুয়েলার প্রতিবেশী আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মেক্সিকোর বক্তব্য স্পষ্ট। তারা কেউ নতুন সংসদকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। অপরদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন নিয়েছে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা। সঙ্কট বৃদ্ধি করা ছাড়া বর্তমান সংসদ স্বল্প মেয়াদে কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। দেশ একনায়কতন্ত্রের পথে হাঁটছে এটিও নিশ্চিত। নতজানু সুপ্রীমকোর্ট সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিধিসমূহ অবৈধ ঘোষণা করছে অথবা সরকার স্রেফ তা উপেক্ষা করছে। লোপেজ ও লেডজেমার গ্রেফতার পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে সরকার দমননিপীড়ন বৃদ্ধিতে বদ্ধপরিকর। বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের নামে এ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করতে চাইছে। যিনি একদা সরকার সমর্থক হলেও এখন কট্টর সমালোচক। তিনি সংসদ নির্বাচনকে অভিহিত করেছেন, ‘জনগণের সঙ্গে পরিহাস বলে।’ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চলমান অচলাবস্থার অবনতি ঘটবে বলেই শঙ্কা। বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক ইউনিটি এলায়েন্স ও তাদের সমর্থক জনতার ক্রোধ বাড়ছে। গত এপ্রিল থেকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় নিহত হয়েছে অন্তত ১২০ জন। কেবল নির্বাচনের দিনই নিহতের সংখ্যা ১০। তারপরও বিরোধী দল ঘোষণা দিয়েছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত ৩৫ জন ভেনিজুয়েলিয়ান নাগরিকের একজন মাদুরো। যে তালিকায় আরও নাম অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা আছে। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হুমকি প্রদান করছে। ভেনিজুয়েলার তেল রফতানি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের। দুভাবে যুক্তরাষ্ট্র এটি করতে পারে। হয় তেল ক্রয় বন্ধ করে অন্যথায় সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টির মাধ্যমে। আর এটি হবে ভেনিজুয়েলার জন্য সত্যিকারের আঘাত। তবে মার্কিন ভূমিকায় এটাও স্পষ্ট তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ব্যক্তি মাদুরো। যা ভেনিজুয়েলাকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী চলমান চক্রান্তের সম্প্রসারণ। অস্ত্র যখন তেল বাস্তবতা হচ্ছে ভেনিজুয়েলার বৈদেশিক মুদ্রার একমাত্র উৎস হচ্ছে তেল রফতানি। আর এই তেলের সর্ববৃহৎ ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। ভেনিজুুয়েলা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে বিকল্প ক্রেতা হয়ত খুঁজে পাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে নিশ্চিতভাবে তাদের হ্রাসকৃত মূল্যে তেল বিক্রি করতে হবে যা হবে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের জন্য একটি বড় আঘাত। এর প্রভাব পড়বে খাদ্য ও ওষুধ আমদানির ওপর। বলা হচ্ছে বামপন্থী সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ ভেনিজুয়েলিয়ানদের জীবন আজ দুর্বিষহ। নিষেধাজ্ঞা পরিস্থিতি ঠেলে দেবে আরও খারাপের দিকে। শেষ পর্যন্ত ভুক্তভোগী সেই জনগণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসনের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য ভেনিজুয়েলার ক্ষমতা পরিবর্তন। পহেলা আগস্ট তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বাস্তবতা উপলব্ধি করে মাদুরো নিজ থেকেই সরে যান। অথবা সাংবিধানিকভাবে তার অপসারণ। তবে কিভাবে এটি সম্ভব তা তিনি বলেননি। অপরদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছে সংঘাত বৃদ্ধির। আর এ আশঙ্কা দুদিক থেকেই। সরকার সমর্থকদলীয় ক্যাডার আর বিরোধীদলীয় সমর্থকদের বড় একটি অংশ আজ অস্ত্র সজ্জিত। বিরোধী ক্যাডাররা সরাসরি আক্রমণ করছে টহল পুলিশের ওপর অহরহ। আইনশৃঙ্খলার অবনতি সেনা হস্তক্ষেপের মতো পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। এরও রয়েছে দুটি দিক। সেনাবাহিনী সরকারের পক্ষ নিয়ে বিক্ষোভ দমনে ভূমিকা নেবে অথবা বিরোধী দলের পক্ষে সরকারবিরোধী পক্ষ অবলম্বন করবে। তবে দ্বিতীয় সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মি. মাদুরো আশা করছেন নবনির্বাচিত আইনসভার মাধ্যমে তৃতীয় একটি পথ বেরিয়ে আসবে। আর সেটি হলো অর্থনৈতিক সংস্কার। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এক নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। যাকে তিনি অভিহিত করছেন, ‘নিউ ভেনিজুয়েলান ইকোনমি।’ যদি সত্যিকারার্থে এই সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন করা যায় সেক্ষত্রে বিরোধী দল হয়ে পড়বে ইস্যুহীন। সেজন্য তাকে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ কঠিন পথ। সূত্র ॥ দি ইকোনমিস্ট
×