ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে ‘তিন তালাক অবৈধ’ ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৩ আগস্ট ২০১৭

ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে ‘তিন তালাক অবৈধ’ ঘোষণা

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ তিনবার ‘তালাক’ উচ্চারণ করে তাৎক্ষণিকভাবে স্ত্রীকে ত্যাগ করার মুসলিম রীতিকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। মঙ্গলবার আদালতের এ রায়কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনন্দন জানিয়েছেন অনেকে, তাদের মধ্যে ‘তিন তালাকের’ মাধ্যমে সংসার হারানো বেশ কয়েকজন মুসলিম নারীও রয়েছেন। খবর বিবিসি ও অনলাইনের। এনডিটিভির খবরে বলা হয়, তিন তালাক নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে বলে দাবি করেছিল ভারত সরকার। এই রায়ের মাধ্যমে আদালতও তাতে সায় দিল। মামলার শুনানিতে থাকা পাঁচজন বিচারকের মধ্যে তিনজন ‘তিন তালাক’কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। অন্য দুইজন সরকারকে নতুন আইন করার সময় দিতে ওই প্রথাটি ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন। হিন্দু, ইসলাম, খ্রীস্টান, শিখ ও জরথুস্ত্র-ভারতের প্রধান এই পাঁচ ধর্ম বিশ্বাসের পাঁচজন বিচারকের একটি প্যানেল এই রায়টি দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে রায়ে বলা হয়, তিন তালাক ধর্মীয় ধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় এবং এটি সংবিধানের লঙ্ঘন। রায় প্রদানকারী বিচারকরা চান, ধর্মীয় আইনের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নিলে যেসব মুসলিম সংগঠন নিজেদের ধর্ম পালনের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণœ করা হচ্ছে বলে আপত্তি তোলে, তাদের উদ্বেগ আমলে নিয়ে সরকার এ বিষয়ে নতুন আইন করুক। ভারতীয় মুসলমানদের ব্যক্তিগত বিধানগুলো দেখভালকারী বেসরকারী সংস্থা অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড (এআইএমপিএলবি) তিন তালাকের ওপর যে কোন নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে বলে আসছিল, এটি আদালতের বিষয় নয়, ধর্মীয় বিষয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের আইন উল্লেখ করে বলেছে, সেসব দেশে তিন তালাকের অনুমোদন নেই। তাই ভারতেও তা থাকা উচিত নয়। তিন তালাক ইসলামের মৌলিক বিধান কিনা এবং এর কোন আইনী বাধ্যবাধকতা আছে কিনা তা এই প্রথমবারের মতো পর্যালোচনা করে দেখেছে ভারতের সুপ্রীমকোর্ট। পাঁচ বিচারকের মধ্যে তিনজন বলেছেন, তিন তালাক কোরানের বিধান লঙ্ঘন করে। তিন তালাকপ্রাপ্ত শায়রা বানুর আইনজীবী বালাজি শ্রীনিবাসন জানান, শায়ারার স্বামী এক খ- কাগজে ‘তালাক’ শব্দটি তিনবার লিখে তার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করেছিলেন। আমরা আদালতকে বলেছি, আইন বা কোরানে এই প্রথার কোন ভিত্তি নাই, বলেন এই আইনজীবী। রায়ের সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ ভারতের সুপ্রীমকোর্টের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছে, তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক এবং তা ইসলাম ধর্ম পালনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত নয়। এই রায়ের পরে সে দেশে তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। যদিও সাংবিধানিক বেঞ্চের ৫ সদস্যের বিচারপতির মধ্যে দুইজন এই মত পোষণ করেছিলেন, আগামী ৬ মাসের জন্য তালাক প্রথা বন্ধ করে রাখা হোক এবং ওই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে আইন পাস করুক। তবে বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক তিনজন তাদের রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন, তিন তালাক প্রথা অসাংবিধানিক এবং ইসলাম ধর্ম পালনের সঙ্গে এই প্রথার কোন যোগ নেই। তাদের রায়ই আদালতের চূড়ান্ত রায় বলে গণ্য করা হবে। ‘৫’ সংখ্যার আলাদা গুরুত্ব একদিকে যেমন সাংবিধানিক বেঞ্চে যে ৫ জন বিচারপতি ছিলেন, কিছুটা নজিরবিহীনভাবে সেখানে ৫টি ভিন্ন ধর্মের বিচারকও রাখা হয়েছিল। আবার এই তালাক প্রথার বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে যতজন তালাকপ্রাপ্ত নারী আবেদন করেছিলেন, তাদের সংখ্যাও ‘৫’। আফরিন রহমান, আতিয়া সাবরি, শায়রা বানু, ইশরাত জাহান ও গুলশান পারভিন- এই ৫ জনের করা আবেদনগুলোই একত্র করে মামলার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত। বাদীদের একজন আফরিন রহমান যা বলেন ২০১৪ সালে আফরিন রহমানের বিয়ে হয়েছিল খুব ধুমধাম করে একটি পাঁচতারা হোটেলে। এমবিএ পাস করা আফরিন সে সময় একটা চাকরি করতেন। কিন্তু আইনজীবী স্বামীর সঙ্গে সংসার করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। বিবিসিকে আফরিন বলছিলেন, যে রকমটা ভেবেছিলাম, যে স্বপ্ন ছিল, বিয়ের পরে সংসার করতে গিয়ে সেটা ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যেতে লাগল। সমানে পণের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল। আমি রুখে দাঁড়ালে গায়েও হাত তোলা হচ্ছিল। আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বিয়ের এক বছরের মাথায় আফরিনের স্বামী তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। কয়েক মাস পরে সড়ক দুর্ঘটনায় আফরিনের মায়ের মৃত্যু হয়, আফরিনও গুরুতর আহত হন। তার বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। ভীষণ একা হয়ে পড়েন আফরিন। চোট থেকে যখন ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন আফরিন, সেই সময়ই তার স্বামী একটা চিঠি পাঠান তাকে এবং আরও কয়েকজন আত্মীয়কে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, তালাক, তালাক, তালাক...। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এক মামাত বোন তাকে সাহস যোগান সেই সময়। বুকে বল নিয়ে তালাক প্রথাকেই ভুল প্রমাণিত করতে সুপ্রীমকোর্টের দ্বারস্থ হন আফরিন। অন্যদিকে স্বামীর বিরুদ্ধে পণের দাবিতে অত্যাচার আর মারধরের অভিযোগে আলাদা মামলা দায়ের করেন। স্বামী আর শাশুড়ি গ্রেফতার হলেও পরে তারা জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। তার কথা, যেসব নারী নিজেদের স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল, তাদের যাতে এই অন্যায় সহ্য করতে হয়, তার জন্যই এই মামলা করেছিলাম। এছাড়া, সাহারানপুর, উত্তরপ্রদেশের আতিয়া সাবরি, কাশীপুর, উত্তরা শায়রা বানু, পশ্চিমবঙ্গের ইশরাত জাহান ও গুলশান পারভিন- সবার নির্যাতিত জীবনের কাহিনী প্রায় একই ধরনের।
×