ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হোয়াইট হাউস কুর্সির কিচ্ছা কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৩ আগস্ট ২০১৭

হোয়াইট হাউস কুর্সির কিচ্ছা কাহিনী

(শেষাংশ) এ্যাটর্নি জেনারেল হয়ে পরবর্তীতে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের তদন্ত কাজ থেকে তিনি নিজেকে প্রত্যাহার করছেন। কিন্তু তার ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল এই স্পেশাল কাউন্সিল গঠন করায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেব সেশনের বিরুদ্ধে অত্যšন্ত ক্ষুব্ধ হলেন স্বভাবতই। একাধিক টুইটের মাধ্যমে তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে জেব এভাবে তার কাছ থেকে সরে যাবেন সেটি জানলে তিনি তাকে এ্যাটর্নি জেনারেল বানাতেন না। নির্বাচনকালীন সময়ে সেশনসই প্রথম সিনেটর যিনি প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সর্বাত্মক সমর্থন জানান। কিন্তু এমন কঠিন মন্তব্যে গুঞ্জন উঠেছিল ট্রাম সেই শুভাকাক্সক্ষী সেশনকে বরখাস্ত করতে যাচ্ছেন। সে কারণে তাকে সমর্থন করে রুষ্ট সিনেটর বন্ধুগণ প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে হুঙ্কার ছেড়েছে সেশনকে সরালে পরিণতি ভাল হবে না। এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রিভিসকে বিদায় করে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রধান থেকে জেনারেল কেলিকে হোয়াইট হাউস চীফ হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন জেব সেশন্স ফের ট্রাম্প মুখো হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন মিডিয়ায় গোপন তথ্য ফাঁসকারীদের কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। বলা বাহুল্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ নানা মিডিয়ায় ৬০টিরও অধিক তথ্য ফাঁসের ঘটনা মার্কিন মডার্ন প্রেসিডেন্সি যুগে সৃষ্টি করেছে সর্বোচ্চ রেকর্ড। ট্রাম্প বলেন এটি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকা- ছাড়া আর কারও নয়। কারণ আমেরিকার ১৭টি গোয়েন্দা সংস্থা এক বাক্যে বলছে নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপের কথা। ইন্টেলিজেন্স কমিটি সেটি নিয়ে তদন্ত করছে এবং বব মুলারের নেতৃত্বে স্পেশাল কাউন্সিলের তদন্ত জাল ছড়িয়ে পড়ছে নানাদিকে। খবরে এসেছে ৩০ বছর ধরে ট্রাম্পের পার্সোনাল সেক্রেটারি রোহন গ্রাফকে সিনেট কমিটিতে শুনানির জন্য হাজিরা দিতে ডাকা হয়েছে। কৌমির অপসারণের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে বিদায় নেয়া হোয়াইট হাউস চীফ রেনো প্রিভিসকে কে তলব করেছে স্পেশাল কাউন্সিল। ইতোপূর্বে ট্রাম্পের ক্যাম্পেন চেয়ারম্যান পল ম্যানফোর্টের ভার্জিনিয়ার আলেকজেন্দ্রিয়াস্থ গৃহে কোর্ট কতৃক সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে এফবিআইএর একটি তদন্তকারী দল। লবিস্ট পল কর্তৃক বিদেশী ব্যাংকে লেনদেন, ট্যাক্স রেকর্ডসহ যাবতীয় নথিপত্র তারা সার্চ করেছে। এর পূর্ব দিনে পলকে হাজির হতে হয়েছিল সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির সামনে। পল ম্যানফোর্ট হলেন একজন খ্যাতনামা আমেরিকান আইনজীবী, লবিস্ট এবং রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এবং ইতোপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, রোনাল্ড রিগান, জর্জ বুশ এবং জিওপি দলনেতা বব ডোলের পরামর্শক ছিলেন। উল্লেখ্য, এক সময় তিনি রাশান সমর্থন পুষ্ট সাবেক ইউক্রেন সরকারের পক্ষে মার্কিন কংগ্রেসে লবিং করেছিলেন। এ বিষয়ে জনকণ্ঠে আমার একটি লেখা ‘ইউক্রেনে উত্তাপ ও আমেরিকান লবিং ব্যবসার মধুমাস’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল বিগত ১৪ সালের ৩১ মে তারিখে। যাই হোক একই কমিটিতে হাজিরা দিয়ে রাশিয়া বিষয়ে আড়াই ঘণ্টা জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে ট্রাম জামাতা কুশনারকেও। ট্রাম্পের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডোনাল্ড জুনিয়র ক্যাম্পেনকালে রাশান সরকারের একজন ল’য়ারের সঙ্গে নিউইয়র্কে মিটিংয়ের খবর প্রকাশিত হওয়ার কারণে তাকেও সেখানে হাজিরা দিতে হবে। ডোনাল্ড জুনিয়র যদিও বলেছেন হিলারি শিবির সম্পর্কে গোপন তথ্য দেয়া হবে বলে তাকে এক ই-মেইলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু এ রকম কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি বলে বৈঠকটিকে তিনি নিষ্ফল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এভাবেই ট্রাম ক্যাম্পেনে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠজনেরা জড়িয়ে যাচ্ছেন তদন্তের জালে। আর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটু একটু করে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলছে সেই জাল। নির্বাচনে রাশিয়ান সংশ্লিষ্টতা ক্রমশই যেন একটি আশঙ্কাজনক পরিণতির দিকে ধাবমান। হোয়াইট হাউস কুর্সির ওপর ঘন কালো মেঘের বিস্তার দেখে ট্রাম্প সাহেব নিশ্চুপ বসে নেই। ভার্জিনিয়ার এক বিশাল র‌্যালিতে উপস্থিত জনতার কাছে জানতে চানÑএখানে কি কোন রাশান আছেন? Ñসমস্বর জবাব ছিলÑনা! -না রাশান নেই, আপনাদের ভোটেই আমি জিতেছি। এরপর তার মন্তব্য ছিল ‘এসব বলার কারণ হিলারির পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেনি। এই কথা শুনে ট্রাম্প শিবিরের মানুষজন দাবি করলেন লিবিয়ার বেনগাজিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যার পেছনে হিলারির ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করার। ট্রাম তার বিরুদ্ধে তদন্তকারীদের উদ্দেশে বললেন এর বদলে বরং হিলারির ডিলিট করা ৩৩ হাজার ই-মেইলের তদন্ত করতে। তিনি প্রশ্ন তুলে আরও বলেন ‘ওবামার শাসন আমলে কথিত এই ঘটনাটি ঘটেছিল কিন্তু এই তিনি কোন তদন্ত করেননি কেন ? ‘সে যাই হোক মার্কিন নির্বাচন পরিচালনাকারীরা দাবি করেন নির্বাচনের সময় রাশিয়া ভোটিং মেশিনগুলো হ্যাক করতে পারেনি। মার্কিন মিডিয়ায় আশঙ্কা প্রয়াস করা হচ্ছে ট্রাম্প নাকি মুলারকে বরখাস্ত করার কথা বিবেচনা করছেন। যদিও হোয়াইট হাউস ও প্রেসিডেন্টের আইনজীবীরা সিএনএনের কাছে দেয়া তার এক বন্ধুর এই মন্তব্যকে বলেছেন স্র্রেফ গুজব এবং সেটি তার ভাবনার মধ্যেই নেই বরং তিনি মুলারকে সহযোগিতায় করে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে আশ্বস্ত হয়নি কংগ্রেস। বরং রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এক জোট হয়ে এমন একটি নয়া আইন করতে যাতে রাষ্ট্রপতি এই কাজ করতে না পারেন। এই দুই পার্টির যুগল মিলনে প্রেসিডেন্ট সাহেব প্রথম সাত মাসে তার নির্বাচন প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আইন পাশে কোন সফলতা অর্জনে সক্ষম হননি। এসবের মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ হেলথ কেয়ার রিফর্ম ও ইমিগ্রেশন। ট্যাক্স রিফর্ম ,মক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ ইত্যাদির কোনটাই আলোর মুখ দেখতে সক্ষম হয়নি। ওবামা কেয়ার বাতিল করে তদস্থলে একটি নয়া হেলথ কেয়ার বিল পাসের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন তিনি। কিন্তু নতুন বিল পাসের প্রাক্কালে রিপাবলিকান সিনেট সদস্যরা মধ্য রাতে যখন প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছিলেন তখন শেষ মুহূর্তে নিজ দলের প্রবীণ সিনেটর যিনি বর্তমানে ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত এরিজোনার সিনেটর ম্যাককেইন ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটরদের সঙ্গে শলাপরামর্শ শুরু করলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। রাত সাড়ে তিনটায় টিভিতে দেখা গেল বিশ পঁচিশজন ডেমোক্র্যাট ম্যাককেইনকে ঘিরে ধরে কথা বলছে। এরপর বিল পাসের সিদ্ধান্তমূলক ভোটটি না সূচক দিয়ে অধিবেশন ত্যাগ করলেন। বিলটি পাশ না হওয়ায় ট্রাম্প দলের সিনেটরদের তিরস্কার করে বললেন -আজ তারা ওবামা কেয়ার বহালে সহায়তা করলেন অথচ সাত বছর ধরে তারাই এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। এত দুর্বিপাকের ভেতরেও ট্রাম্পের জন্য স্বস্তির বিষয় হলো আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নতি এবং স্টক মার্কেটের সর্বোচ্চ সূচকে অবস্থান এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি যা জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৬ বছরের মধ্যে বেকারত্বের সর্বনিম্ন হার এবং সর্বপরি নিজ দলের সমর্থকদের মধ্যে তার দৃঢ় অবস্থান। ২০২০ সালে ৫২% রিপাবলিকান তাকেই প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। তবে জাতীয়ভাবে তার সমর্থন মাত্র ৩৬% যা ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণে সর্বনিম্ন। তবে এর বিপরীতে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন কি বেড়েছে। সেটি আলোর দিকে তুলে ধরলে দেখা যাবে সাম্প্রতিক সমীক্ষায় গরিষ্ঠ মার্কিন লোকজন মনে করে ট্রাম্প বিরোধিতা করা ছাড়া তাদের আর কোন এজেন্ডা নেই। তারা ধরেই নিয়েছিল হিলারি নির্বাচনে জিতবেন, কিন্তু হোয়াইট হাউস কুরসি হারানোর বেদনায় তারা এখনও উদ্বেল। তাই বলতে হয় ইয়ে এক কিচ্ছা কুরসি কি কাহানি! লেখক : আমেরিকা প্রবাসী কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×