ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারপতি জয়নুল কমিশনের তদন্ত রিপোর্টও গায়েব!

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৩ আগস্ট ২০১৭

বিচারপতি জয়নুল কমিশনের তদন্ত রিপোর্টও গায়েব!

শংকর কুমার দে ॥ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত করতে সেই বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে গঠিত এক সদস্যের তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটি কি গায়েব হয়ে গেছে? বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে জমা দিয়েছিলেন তদন্ত কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর যে উদ্যোগ নিয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাতে বাধা দিয়েছেন তার আলোকেই এখন আবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত প্রতিবেদনটির খোঁজ পড়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটির হদিস মিলছে না। প্রশ্ন উঠেছে, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনটিও গায়েব করে দেয়া হয়েছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তিন দিন পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিচারপতি মোঃ জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। ১ মাস ১০ দিনের তদন্ত শেষে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল বলে সংগৃহীত তথ্য প্রমাণে জানা যায়। বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার তদন্ত প্রতিবেদনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পেছনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ইঙ্গিত করে একটি বিদেশী শক্তি জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন। এই ঘটনায় বিএনপি বা জামায়াত জড়িত নয় বলে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রেনেড হামলাকারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, সম্পূরক চার্জশীটে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম আসামি হন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পতনের আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে জমা দেয়া বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনটি কি গায়েব করে দেয়া হয়েছে কিনা তার খোঁজ নেয়া হচ্ছে। বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে আরও একটি জজ মিয়া নাটকের মতোই নাটক সাজিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন প্রতিবাদও করা হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তের উদ্যোগ নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সেই বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের দুর্নীতি তদন্তে বাধা দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ধামাচাপা দিতে বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার তদন্ত প্রতিবেদনে কি ধরনের প্রক্রিয়া আশ্রয় নিয়েছিলেন তা খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া তদন্ত প্রতিবেদনটির খোঁজ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, গ্রেনেড হামলা এমনভাবে করা হয়েছে যেন শেখ হাসিনা বেঁচে যান এবং জোট সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যায়। ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সংসদ সদস্যরা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়ে এখন নৈরাজ্যের মাধ্যমে তারা (আওয়ামী লীগ) ক্ষমতায় যেতে চায়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সমাবেশে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছে। তখন বিএনপি ওই নৃশংস হত্যাকা-ের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল। বিএনপি-জামায়াতের নেৃতত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের তদন্ত কমিশনের কাছে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহীম যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা তো সেই একই কথা, যা বলেছিলেন চারদলীয় নেতা-মন্ত্রীরা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা যা বলেছিলেন, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ৪০ দিনের অনুসন্ধানে প্রস্তুত তদন্ত প্রতিবেদনে সেসব মনগড়া তথ্য-ব্যাখ্যাই দেয়া হয়েছিল, যা তার প্রতিবেদনে প্রায় একই কথা বলেছিলেন। সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার তদন্ত প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ওই গ্রেনেড হামলা চালায় বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গ্রেনেড হামলার তিন দিন পর ওই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করার হলে তদন্ত শুরুর পর কয়েক দফায় কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ঘটনাস্থলে গিয়ে ১২৩ ব্যক্তির সাক্ষ্য নেন। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কয়েকবার বিশেষ বৈঠক করেন তিনি। তবে ঘটনায় বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে উল্লেখ করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (পরে গ্রেনেড হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি) লুৎফুজ্জামান বাবরের কাছে সেটি দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেদনটি জমা হওয়ার পর কখনও প্রকাশ করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিচারপতি জয়নুল আবেদীন কমিশনের ওই প্রতিবেদন খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এ জন্য তৎপর হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তদন্ত প্রতিবেদনটি পাওয়া যাক বা না পাওয়া যাক, প্রয়োজনে কমিশনের প্রধানের সঙ্গেও কথা বলতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কমিশনের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখা হবে। কারও গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×