ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাইকোর্টে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা ॥ ১৫ ফাঁসি বহাল

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ২৩ আগস্ট ২০১৭

হাইকোর্টে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা ॥  ১৫ ফাঁসি বহাল

বিকাশ দত্ত ॥ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ-আরিফ-মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বাকি ১১ জনকে দ- কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। আসামিদের করা জেল আপীল ও রাষ্ট্রপক্ষের করা ডেথ রেফারেন্সের ওপর রায় ঘোষণা করে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট দ্বৈত বেঞ্চ। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় তারা এ রায় পড়া শুরু করেন এবং তা শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৪টায়। রায়কে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে ও এজলাসের বাইরে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। প্রথমে এজলাসে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি না দেয়া হলেও পরে দেয়া হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, ‘র‌্যাব একটি এলিট ফোর্স। তাদের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। তারা জনগণের নিরাপত্তা দেয়া ও রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনেক কাজ করেছে। কিন্তু এ বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের কারণে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। তারা যে অপরাধ করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রাপ্য। ফলে তাদের বিচার হয়েছে।’ আদেশের পর প্রতিক্রিয়ায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ খুনের সঙ্গে জড়িত থাকায় এটি দৃষ্টান্ত রায়। ১১ জনের মৃত্যুদ-ের সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন করায় আপীল করা হবে কি-না এ বিষয়ে রায় দেখে চিন্তা-ভাবনা করা হবে। এছাড়া মামলার অন্য আসামিদের যে দ- দেয়া হয়েছে তা বহাল থাকবে বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, এ রায়ে স্বস্তি অনুভব করছি। অন্যদিকে নুর হোসেন ও সাঈদ তারেকের আইনজীবীরা বলেছেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। অন্যদিকে নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বিউটি রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন। রায়কে ঘিরে নারায়ণগঞ্জের অনেকেই এসেছিলেন আদালত অঙ্গনে। তারা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অধীর আগ্রহে রায়ের জন্য অপেক্ষা করেন। যাদের মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার সাবেক মেজর আরিফ হোসেন, র‌্যাবের ক্যাম্প কমান্ডার সাবেক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মোঃ শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দু বালা, সৈনিক আব্দুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সৈনিক আল আমিন। মৃত্যুদ-ের সাজা কমে যাদের যাবজ্জীবন হয়েছে তারা হলেনÑ সৈনিক আসাদুজ্জামান নুর, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, নুর হোসেনের সহযোগী মুর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু ওরফে মিজান, মোঃ রহম আলী, মোঃ আবুল বাসার, সেলিম, মোঃ সানাউল্লাহ ওরফে সানা, ম্যানেজার শাহজাহান, জামাল উদ্দিন। বিভিন্ন বাহিনীর যেসব সদস্যের সাজা হয়েছে তাদের নিজ নিজ বাহিনী থেকে আগেই বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্য নয়জনকে নিম্ন আদালত যে সাজা দিয়েছে তা হাইকোর্টে বহাল রাখা হয়েছে। তারা হলেনÑ কনস্টেবল (পরে এএসআই) হাবিবুর রহমান ও এএসআই আবুল কালাম আজাদকে ১৭ বছর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহী নুরুজ্জামানকে ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে সাত বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে দুজন পলাতক রয়েছেন। তারা হলেনÑ কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান ও এএসআই কামাল হোসেন । কড়া নিরাপত্তা ॥ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপীলের রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্ট এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিন দেখা যায়, আদালত এলাকায় পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাদা পোশাকের গোয়েন্দারাও উপস্থিত আছেন। আদালতের গেটে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সদস্যরা তল্লাশি করে আদালত ভবনের দোতলায় প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয় হাইকোর্ট ভবনের দ্বিতীয় তলার ১১ নম্বর রুমে। ওই কক্ষের গেটে শাহবাগ থানা পুলিশের ৭-৮ জন সদস্য নিরাপত্তায় ছিলেন। আইনজীবী ও নিহত পরিবারের সদস্য ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। দুই দফায় কয়েকজন সাংবাদিককে কোর্টে ঢুকতে দেয়া হয়। এ বিষয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল জামান জানান, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সবাইকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। রায়ে সন্তুষ্ট নজরুলের পরিবার ॥ নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ- পাওয়া ২৬ জনের মধ্যে ১৫ জনের সর্বোচ্চ সাজা বহাল রাখায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম (শহীদ চেয়ারম্যান)। নজরুলের শ্বশুর বলেন, ‘মূল আসামিদের জজকোর্টে ফাঁসি হয়েছে, হাইকোর্টেও ফাঁসি বহাল রয়েছে। আমরা এ রায়ে খুশি। এখন আমরা চাই দ্রুত এ রায় কার্যকর করা হবে।’ ফাঁসির আসামি হলেও নূর হোসেনকে কনডেম সেলে না রেখে সাধারণ কয়েদিদের সেলে রাখা হচ্ছে- এমন অভিযোগ করে শহীদ চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহযোগিতায় নূর হোসেনকে ভারত থেকে এনে আদালতে দাঁড় করিয়েছেন। জজকোর্টের রায়ে তার ফাঁসির দ- হয়েছে। তার থাকার কথা কনডেম সেলে। কিন্তু তাকে রাখা হচ্ছে সাধারণ কয়েদিদের সেলে। নূর হোসেনের বেলায় কারবিধি মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। আপীল করবেন নূর হোসেন ॥ রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নূর হোসেনের আইনজীবী এসআরএম লুৎফর রহমান আখন্দ বলেন, আমরা এ রায়ে সংক্ষুব্ধ, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। আদালত আইনের বিধান ও লিগ্যাল সাবমিশন বিবেচনায় না নিয়ে রায় দিয়েছে। আমরা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করব। রায়ের কপি পেয়ে আগে আমরা সিভিল মিস পিটিশন (সিএমপি) করব। তিনি আরও বলেন, নিহত নজরুলের স্ত্রী পূর্বশত্রুতার জের ধরে নূর হোসেনসহ ছয়জনের নামে মামলা করেন। মামলার চার্জশীটে পাঁচজনকে বাদ দিয়ে শুধু নূর হোসেনের নাম রাখা হয়েছে। ওই পাঁচজনকে কেন বাদ দেয়া হলো, শুধু নূর হোসেনকে কেন রাখা হলো চার্জশীটে তা লেখা নেই। উচ্চ আদালতে যাবেন তারেক সাঈদ ॥ তারেক সাঈদের আইনজীবী এ্যাডভোকেট ফজলুল হক খান ফরিদ বলেন, আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট নই। দুটি পর্যায়ে সাত খুনের ঘটনাটি ঘটানো হয়। ষড়যন্ত্র এবং হত্যাকা-। এ দুইয়ের কোন পর্যায়েই তারেক সাঈদ জড়িত ছিলেন না। কিন্তু অন্য লিংকে জড়িয়ে তাকে ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ে লিগ্যাল প্রসেসে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। আশা করছি সেখানে ভাল ফল পাব। এর আগে নারায়ণগঞ্জে বহুল আলোচিত চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপীল এবং ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১৩ আগস্ট দিন নির্ধারণ করা হয়। পরে তারিখ পরিবর্তন করে ২২ আগস্ট দিন নির্ধারণ করে বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ। আদালতে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেনÑ সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান, এ্যাডভোকেট মোঃ আহসান উল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেনÑ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সরোয়ার কাজল ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। এর আগে গত ১৭ মে আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ২২ মে সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীলের শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নূর হোসেনসহ আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপীল শুনানির জন্য গ্রহণ করে হাইকোর্ট। গত ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত নূর হোসেন, তারেক সাঈদসহ আসামিরা খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপীল করেন।
×