ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

দর্শনের দৈন্যে বন্দী

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২৩ আগস্ট ২০১৭

দর্শনের দৈন্যে বন্দী

প্লেটোর বিধান মেনে দেশে দেশে রাজা না হলেও সভ্যতার নতুন ইতিহাস নির্মাণের আদর্শিক ভিত তৈরি করেছিলেন দার্শনিকরাই। আঠারো শতকে ফরাসী বিপ্লবের দার্শনিক পটভূমি সেখানকার মানুষদের মন আলোকিত করেছিল বলেই দ্রুত বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। সে যুগ ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে এজ অব এনলাইটেনমেন্ট হিসেবে। ফরাসী বিপ্লব শ্রেণী শোষণ বা ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করেনি সামন্ততন্ত্রকে আঘাত করেছিল এবং সে সময় তাই ছিল তার প্রগতিশীল ভূমিকা। এর অশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ফ্রান্সের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের চেতনাকে শুধু নয়, গোটা ইউরোপকে এ বিপ্লব আলোড়িত করেছিল। ভাববাদী দর্শনের জায়গায় বস্তুবাদী দর্শন প্রতিস্থাপনের পথ তৈরি করেছিল। রুশো, দিদারো, এলেমবাট, হলবাক, ভলতেয়ার হেলবেটিয়াসরা ছিলেন সে সময়ের বস্তুবাদী দার্শনিক। সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এদের মতাদর্শিক সংগ্রাম চার্চ ও যাজকতন্ত্রের বাইরে এসে বিজ্ঞানমনস্কতার পথ দেখায়। আঠারো শতকের আগে আরেক বস্তুবাদ ধর্ম ও ঈশ্বরতত্ত্ব আঁকড়ে বিকশিত হয়েছিল আমাদের সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুদের পিতৃভূমি ব্রিটেনে। ফরাসী বস্তুবাদ থেকে যা একেবারে আলাদা। এ উপমহাদেশে সভ্যতাভব্যতার পাঠ যেমন তারা আমাদের দিয়েছে তেমনি রাজনীতির প্রায়োগিক পাঠও। প্রাচ্য দর্শনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এখানে থাকলেও রাজনীতির সঙ্গে তার যোগ ছিল না। ব্রিটিশ বস্তুবাদের ভাবশিষ্য হয়েই এখানকার রাজনীতি এগিয়েছে। তবে তাদের বিদায়ের পর এ অঞ্চলের রাজনীতি ভিন্ন বাঁকে মোড় নিয়েছে। ভারত ভাগ হওয়ার বছর দুয়েক আগে বিশ্বরাজনীতিতে প্রভু বদল হওয়ায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য পাকিস্তানের। ভারতকে চাপে রাখার নেপথ্য কৌশলের এ সখ্য পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত করে এ অঞ্চলে প্রগতিশীল আন্দোলনবিরোধী বলয় তৈরিতে ব্যবহার করেছে। এ কাজে তুরস্ক ও ইরান ছিল পাকিস্তানের সহযোগী এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম। পাকিস্তান যখন নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে আঁস্তাকুড়ে তলানোর পাকা বন্দোবস্ত করছে, ভারত তখন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের বিকাশ ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে মনোযোগী হয়ে পায়ের তলার মাটি শক্ত করছে। নিজস্ব শিল্প ভিত্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন ভারতের রাজনীতিকেও স্থিতিশীল রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সখ্য রেখেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছে ক্রমশ। বাংলাদেশ পথ চলেছে মিশ্র পদক্ষেপে। অনেক সময়ই ধনী দেশের গবেষণার কেন্দ্রে থেকেছে। এনজিও মডেলের সফল রূপকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বার বার সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতায় গেছে। অর্থনীতির গতিমুখ শেষ পর্যন্ত কৃষিপ্রধান থেকে সার্ভিস প্রাধান্যে বাঁক নিয়েছে। শিল্পের শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠার আগেই সার্ভিস সেক্টর বিকশিত হওয়ায় ব্যবসায়িক লেনদেন আমদানিনির্ভর হয়েছে। প্রচুর সুপার মার্কেট, শপিংমল হয়েছে। গত তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে দেশে আমদানি-রফতানি দুই-ই বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ নেয়ার হারও বেড়েছে। তবে শুধু বৈদেশিক বাণিজ্যে নয়, বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরির আরও যেসব কারণ রয়েছে তার মধ্যে রেমিটেন্স উল্লেখযোগ্য। যা হোক, দেশে একটা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যাদের হাতে প্রচুর টাকা এবং তা তাদের রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান করেছে। আমদানিনির্ভর পণ্যের ব্যবসা প্রসারিত হয়েছে এ মানসিকতার জনশক্তি তৈরি হয়েছে। পড়াশুনার বিষয় হিসেবেও এদিকে ঝোঁক ক্রমশ বেড়েছে। পাশাপাশি দর্শন ইতিহাস সাহিত্য সমাজবিজ্ঞানের মতো মৌলিক বিষয়ে আগ্রহ কমছে। একই সঙ্গে রাজনীতিও মৌলিকত্ব হারিয়েছে। স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে অথবা এখনও কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে সাংগঠনিক চর্চার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছেন। কিন্তু সৃজনশীল রাজনৈতিক চর্চা এড়িয়ে যারা ‘ভিন্ন পন্থায়’ রাজনীতিতে এসেছেন তারা খেই হারিয়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশ সমাজ সময় না বুঝে তারা অন্ধের মতো চলছেন। শুধু ক্ষমতা বদল নয়, বদলানো সময়কে ধরতে পারাও সফল রাজনীতির শর্ত। সময়ের সঙ্গে কীভাবে একটি দেশ নিজেকে বদলে নেয় চীন তার উদাহরণ। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে পুরনো শোষকদের উচ্ছেদ করে যুগযুগান্তের প্রচলিত কুসংস্কার নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ইত্যাদির আমূল পরিবর্তন করে সে দেশে সমাজ বিপ্লব হয়। ১৫১৩ সালে পর্তুগীজরা চীনে পৌঁছানোর পর থেকেই ও দেশের প্রতি বিদেশীদের আগ্রহের শুরু। বিভিন্ন অপমানজনক ব্যবসায়িক চুক্তি ও শর্তে চীন সে সময় লাভজনক ব্যবসাকেন্দ্র হয়, বিশেষ করে ইংরেজ ও ফরাসীদের কাছে। চীনের জনগণের মধ্যে বিক্ষোভের বীজ সঞ্চার মূলত তখন থেকে। শক্তিশালী বিদেশী দখলদারদের উৎখাত করেছিল চীনের সাধারণ মানুষ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে। পরের সমাজ বিপ্লব হয়েছিল মাঝের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ও উৎকর্ষের পরিণতি হিসেবে। মাঞ্চুরাজ বংশসহ অন্যান্য সামন্ত প্রভুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ চীন সময়ের সুর ধরে সমাজ বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তার পর তারা শুধু সামনে এগিয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনীতি ও রাজনীতির বাঁক ঘুরিয়ে চীন আজ কোথায় পৌঁছেছে তা আমরা দেখছি। এত বিশাল জনসংখ্যার দেশ যদি সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে পারে তাহলে আমাদের অসুবিধা কোথায়? আমাদের রাজনীতিকরা নিজেদের একটু বদলালে একটু সময়ানুগ হলে রাজনীতি গতি পায়। অনেক সময় পেরিয়ে বহু ঘটনা জন্ম দিয়ে আজও বাংলাদেশের রাজনীতি আটকে আছে ট্রাইবাল টোটেমে। টোটেম বন্দনায় ফিলোসফি নেই ক্ষমতায় যাওয়ার নিম্নমানের কৌশল ছাড়া। উৎস মানুষ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে হতে রাজনীতি এখন ব্যক্তি স্বার্থের পকেটে ঢুকেছে। দেশের মানুষ যেখানে একেবারেই গৌণ। এ বদ্ধ অবস্থা থেকে রাজনীতিকদের মুক্ত হতে হবে আগে তবেই রাজনীতির বিকাশ হবে। [email protected]
×