ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল মালেক

হোয়াইট হাউস কুর্সির কিচ্ছা কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২২ আগস্ট ২০১৭

হোয়াইট হাউস কুর্সির কিচ্ছা কাহিনী

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধান কৌশলবিদ হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট স্টিভ ব্যাননকে তার চাকরি থেকে অবশেষে সাত মাসের মাথায় বরখাস্ত করা হলো। সূত্র মতে ব্যাননকে দুই সপ্তাহের জন্য সময় দিয়ে পদত্যাগ অথবা বরখাস্ত এই দুটি বিকল্প দিয়ে অবশেষে বাধ্য করা হলো সরে যেতে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সারা হাকাবি স্যান্ডার্স ব্যাননের প্রস্থান নিশ্চিত করেছেন, এই বলে ‘হোয়াইট হাউসের প্রধান স্টাফ জন কেলি এবং স্টিভ ব্যানন পারস্পরিকভাবে সম্মত হয়েছেন যে শুক্রবারই হবে তার কর্মের শেষ দিন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবারের মতো বড়সড় এক ছুটি কাটাচ্ছেন তখনই ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে ঘটে গেল শেতাঙ্গ উগ্র বর্ণবাদী নাম অভিহিত হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট, ক্লু ক্লাক্স ক্লান ও নিও নাৎসীদের সঙ্গে মানবতাবাদী কর্মীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ- এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যখন উভয় পক্ষকে সমভাবে দোষারোপ করে বক্তব্য দিলেন তখন এটি সমগ্র আমেরিকায় তুলেছে প্রবল সমালোচনার ঝড়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীনের পর থেকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভবনে পরিস্থিতি একে একে এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে মিডিয়া কর্তৃক যাকে আখ্যা দেয়া হয়েছে ‘সিভিল ওয়্যার ইন হোয়াইট হাউস!’ একের পর এক হায়ার ফায়ারের গোলাগুলির মধ্যে অবস্থাটি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট স্টিভ ব্যাননের এই বরখাস্ত। তার পূর্বে কম্যুনিকেশন ডিরেক্টর এ্যান্থনি স্ক্যারামুচি গত ২৫ জুলাই নিয়োগ পেয়ে বরখাস্ত হলেন ১১ দিনের মাথায়। মুচির আগে আগে গেলেন হোয়াইট হাউস চিফ রেনো প্রিভিস। মুচিতো স্বপদে যোগদান করেই মিডিয়ায় প্রকাশ্য বিষোদ্গার করা শুরু করেছিলেন প্রিভিসের বিরুদ্ধে। অথচ রিপাবলিকান দলের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন প্রিভিসের সর্বাত্মক সমর্থনের বলেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কন্টাককির্ন হোয়াইট হাউসের যাত্রা পথ সহজ হয়েছিল অনেকটাই। লোকে বলে তদানীন্তন হোয়াইট হাউস চিফ অব স্টাফ প্রিভিসকে উৎখাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে প্রেসিডেন্টই নাকি তলে তলে ইন্ধন যুগিয়েছেন তার তখনকার ‘প্রিয়মানুষ’ নিউইয়র্ক ওয়াল স্ট্রিটের এই এ্যান্থনি স্ক্যারামুচিকে। কিন্তু বড়র পিরিতি এমনি বালুর বাঁধ যে মাত্র ১১ দিনেই মুচির হাতের চাঁদ পরিণত হলো রজ্জুতে-দড়ি হাতে তাকেও বিদায় হতে হলো। প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার সম্পর্কে অনাগ্রহ দেখিয়ে ইতোপূর্বে ট্রাম্প তাকে ও বাই বাই করলেন যেমনটি হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। ইতোপূর্বে তো ট্রাম্পের হাতে ফায়ার হতে হয়েছে ফর্মার এফবিআই প্রধান জেমস কৌমিকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হায়ার করা নতুন হোয়াইট হাউস চিফ সিভিলিয়ান নন, তিনি ছিলেন ট্রাম্প মন্ত্রিসভার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি প্রধান। তিনি হচ্ছেন একজন সাবেক জেনারেল নাম জন কেলি। জে. কেলি গত মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ড একাডেমি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ট্রামকে একটি ক্ষুরধার তরবারি হস্তান্তর করে মজাদার এক ঠাট্টা করেছিলেন : ‘প্রেসকে শায়েস্তা করার জন্য এটি ব্যবহার করুন, স্যার।’ তখুনি রতœ হিসেবে ট্রাম্পের নজর কেড়েছিলেন তিনি। ট্রাম্পের নতুন প্রধান হিসেবে এখন জেনারেল সাহেবের নিজেরই কিছু অস্ত্রের প্রয়োজন। তবে অবাধ্য সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে নয়, হোয়াইট হাউসের পশ্চিম ডানাকে শায়েস্তা করার জন্য। সামরিক বাহিনীর কায়দায় অদ্ভুতভাবে তিনি ফল ইন করালেন হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টাসহ সমুদয় ২০০ জন্য কর্মীকে। প্রিভিস সাহেব হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ থাকাকালীন অবস্থায় ওয়েস্ট উইঙ্গে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছিল। তাকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি রিপোর্ট এবং প্রতিশ্রুতি আদায় করার রীতি প্রচলন করেছিলেন। হোয়াইট হাউসকে শিক্ষা দেয়ার মতো বিশ্বের কঠিনতম দায়িত্ব পালন এক জন জেনারেলের পক্ষে সম্ভব কিনা তা দেখার বিষয়। তাছাড়া অভিজ্ঞ সমরবিদ হলেও রাজনীতির সঙ্গে কখনই তার কোন যোগ সূত্র ছিল না। তাই প্রেসিডেন্টের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি সিনেটর ও প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের কাছে লবিং করতে কতটুকু সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারবেন সেটা বলা মুশকিল। তা ছাড়া সমালোচকরা বলেন ওয়েস্ট উইংয়ের যাবতীয় সমস্যার মূলে যেখানে রয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট সেখানে কোথায় লাগবেন জেনারেল সাহেব! আমেরিকার বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে এফবিআইয়ের গঠিত একটি স্পেশাল কাউন্সিল জোরেশোরে তাদের তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক ফেডারেল গ্রান্ড জুরির মাধ্যমে তদন্ত করছে প্রাক্তন এফবিআই ডিরেক্টর রবার্ট মুলারের নেতৃত্বে এই কাউন্সিল। ইলেকশন ক্যাম্পেনকালীন সময়ে ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে এর অন্তর্ভুক্ত থাকছে রাশিয়া কর্তৃক মার্কিন নির্বাচন হ্যাকিংসহ প্রভাব বিস্তার এবং আর্থিক লেনদেন বিষয়। মুলারের স্পেশাল কাউন্সিল ও এফবিআই ব্যাপারটি নিয়ে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। এই সংশ্লিষ্টতায় ট্রাম্প ক্যাবিনেটের প্রথম ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার মাইকেল ফ্লিনের সঙ্গে রাশার যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে এই অভিযোগে মাত্র ২৪ দিনের মাথায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এবার নতুন করে হোয়াইট হাউসের কাছে সাবেক সেই এডভাইজার ফ্লিনের রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বিষয়ে নথিপত্র চেয়েছেন রবার্ট মুলার। প্রসঙ্গ ক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯৮ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে পলা জোন্স নামে এক নারী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একটি ল’ স্যুট দায়ের করেছিলেন। ফলে পারজুরি এবং অবস্ট্রাকশন অব জাস্টিসের কারণে কংগ্রেস ক্লিনটনকে ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন করেছিল গ্রান্ড জুরি। আর এই বর্তমান গ্রান্ড জুরি তদন্তের স্বার্থে যে কোন ব্যক্তিকে যেমন সমন জারি করতে পারবে তেমনি পারবে যাবতীয় নথিপত্র তলব করতেও। এসব ব্যাপারে কোন তথ্য গোপন করা কিংবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অপরাধ বলে গণ্য হবে। সুতরাং সহজেই অনুমেয় স্পেশাল কাউন্সিল একটি কঠিন ঠাঁই। আসলে ডোনাল্ড ট্রাম হোয়াইট হাউসের অধিবাসী হওয়ার পর থেকেই তার এক সময়ের বন্ধুদেশ রাশিয়ার গেরো আক্ষরিক অর্থেই তার পিছু ছাড়ছে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার বিষয়টিকে ‘উইচ হান্টিং’ আখ্যা দিয়ে আসছেন শুরু থেকে। কিন্তু ইদানীং সেই মন্তব্য ঘটমান ঘনঘটার হালে পানি দিতে অপারগ। নির্বাচন ’১৬তে নিজ ক্যাম্পেনের রাশান সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্তে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প খুবই রুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ। নানা মহল থেকে অভিযোগ এসেছে রাশান ইনভেস্টিগেশন বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট প্রাক্তন এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কৌমীকে বরখাস্ত করেছেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য হলো যে প্রাক্তন এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কৌমি বরখাস্ত হওয়ার পূর্বে তিনটি অকেশনে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন রাশিয়ান ইনভেস্টিগেশনের টার্গেট কি ট্রাম্প নিজেই এবং প্রতিবারেই এর জবাব পেয়েছিলেন না সূচক। তিনি এই বরখাস্তের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল রোজেনস্টাইনের কৌমি বরখাস্ত সংক্রান্ত একটি মেমো যেটিকে তিনি এ্যাটর্নি জেনারেল জেব সেশনের হাতে হস্তান্তর করেছিলেন। উল্লেখ্য, ক্ষমতায় বসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ট্রাম্পই রোজেনস্টাইনকে নিয়োগ দেন। আশ্চর্যের কথা প্রশাসন কর্মকর্তারা যে রোজেনস্টাইনের লিখিত মেমোকেই বহুল বিতর্কিত কৌমি বরখাস্তের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবার সেই একই ব্যক্তি কিছু দিন পরেই রবার্ট মুলারকে প্রধান করে গঠন করেছেন এমন শক্তিশালী কাউন্সিল। যার মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারাভিযান কালে রাশিয়ান সরকার এবং সংশ্লিষ্ট যে কোন লিঙ্ক অথবা সমন্বয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফেডারেল অপরাধের ধারায় ক্রিমিনাল চার্জ আনার ক্ষমতা প্রদান করেছেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল। যাই হোক ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন তদন্ত কাজে মুলার যে দু’ডজনের বেশি এ্যাটর্নি নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে হিলারি ক্লিনটনের সমর্থক ব্যক্তিরা। তিনি আরও বলছেন সবচেয়ে বড় কথা রবার্ট মুলার স্বয়ং একজন অবসরপ্রাপ্ত এফবিআই চীফ এবং বহুল আলোচিত চাকরিচ্যুত এফবিআই প্রধান কৌমির বন্ধু। প্রেসিডেন্টের চারপাশে পুতিনের দেশ নিয়ে চলছে নানা ঘটন অঘটন। বর্তমান এ্যাটর্নি জেনারেল জেব সেশন তার এ্যাটর্নি জেনারেল পদটি নিশ্চিতকরণ শুনানির শপথের সময় বলেন, যে নির্বাচনকালীন সময়ে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কখনও যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খবর প্রকাশিত হয় যে আমেরিকায় নিযুক্ত সে সময়ের রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত সের্গেই কিসালাকের সঙ্গে তার দু’বার সাক্ষাত হয়েছিল। চলবে... লেখক : আমেরিকা প্রবাসী কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×