ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরী গবেষক মোস্তফা সেলিম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ আগস্ট ২০১৭

নাগরী গবেষক মোস্তফা সেলিম

পৃথিবীতে প্রচলিত বহু ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই, এমনকি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা স্প্যানিশের নিজস্ব লিপি নেই। স্প্যানিশ লেখা হয় রোমান হরফে। কিন্তু বাংলা ভাষা পৃথিবীতে ব্যতিক্রম। বাংলা ভাষার রয়েছে দুটো বর্ণমালা। বাংলা লিপির পাশাপাশি রয়েছে, অন্য আরেকটি লিপি বা বর্ণমালা। এটি হচ্ছে সিলেটের নাগরী লিপি। বাংলা বর্ণমালার এ লিপিটি বিকল্প লিপি হিসেবে পরিগণিত হয় সাহিত্য বোদ্ধামহলে। প্রায় ছয় শ’ বছর আগে সিলেট অঞ্চলে এ লিপির উদ্ভব হয়। সিলেট অঞ্চলের অসংখ্য ফকির-সাধক-পীর-দরবেশ নাগরী লিপির সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন। নবীর জীবনী যেমন রচিত হয়েছে নাগরী লিপিতে, তেমনি প্রেম-প্রণয় কাহিনী, সামাজিক উপাখ্যান, ধর্মীয় কাহিনীও রচিত হয়েছে এ লিপিতে। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও ছিল নাগরী সাহিত্য পঠনপাঠনের চর্চা। চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র এ লিপি উদ্ভবের পর থেকেই রচিত হয়েছে দু’শতাধিক গ্রন্থ, বিভিন্ন সাহিত্য ও গান। দলিল-দস্তাবেজ তৈরিসহ ওই সময়ের দৈনন্দিন কাজ চলেছে নাগরী লিপি ব্যবহার করেই। সময়ের বিবর্তনে এ লিপি এখন বিলোপ হতে বসেছে। বাংলা ভাষা সাহিত্যের এই রতœভা ারের বিলুপ্তি ঠেকাতে এগিয়ে এসেছেন এক ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষ। তিনি একাধারে এর সংগ্রাহক, গবেষক এবং প্রকাশক। শেকড় অনুরাগী এই মানুষটি হচ্ছেন মোস্তফা সেলিম। প্রায় এক দশক ধরে প্রাচীন পুঁথির সন্ধানে মোস্তফা সেলিম ঘুরে বেড়াচ্ছেন সিলেটের এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্র্ভর প্রাচীন বইপুস্তক ও পুঁথি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ছেড়েছেন শিক্ষকতা। তবে কেবল সংগ্রহের মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি। এসব নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাগরী লিপি সাহিত্য ভা ার পুনরুদ্ধারের জন্য অহরাত্রি তার ব্যস্ততা। মোস্তফা সেলিমের জন্ম মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা জেলার ইটাউরি গ্রামে। বাবা মোস্তফা উদ্দিন, মা আমেনা খাতুন। ছোটবেলার থেকেই অজানাকে জানার নেশা পেয়ে বসে তাকে। ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। এ সময় তিনি কবিতা লিখতেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালে সম্পাদনা করেন সাহিত্যপত্র ‘উদ্দাম’। তখনই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী নাগরী লিপির বিষয়টি জানতে পারেন। কথা হচ্ছিল এই গুণী মানুষটির সঙ্গে। তার শুরুর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিলেটের এমসি কলেজের গণিত বিষয়ের শিক্ষক এরহাসুজ্জামান তার কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নাগরী লিপি হাতে-কলমে শেখাতেন। বিষয়টি মোস্তফা সেলিম তার বন্ধুদের কাছে শুনেছিলেন। নাগরী লিপি ও তার সাহিত্য বিষয়ে তখন জানতে পারেন তিনি। তার উপলব্ধি হয় বাংলা ভাষায় ব্যতিক্রমী এই সাহিত্যসম্পদ সামগ্রিকভাবেই বাঙালীর ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তার মনে হলো, নাগরী লিপিকে সংরক্ষণ প্রজন্মের কাছে নিয়ে যাওয়া না যায় তবে এক সময় এই লিপি হারিয়ে যাবে। আমরা হারিয়ে ফেলব আমাদের প্রাচীনতম বর্ণমালা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী মোস্তফা সেলিম শিক্ষকতা শুরু“ করেন ১৯৯৬ সালে। এ সময় তার হাতে আসে ১৯১০ সালে প্রকাশিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত সিলেটের ইতিহাসনির্ভর প্রথম গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তসহ আরও দুর্লভ এবং প্রাচীন বেশ কিছু বই। দুর্লভ বইগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে তিনি সেসব সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন। পাশাপাশি নিজেও স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে লিখতে থাকেন এবং তখনই প্রকাশিত হয় তার রচিত মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা এবং বড়লেখা অতীত ও বর্তমান গ্রন্থগুলো। ২০০১ সালে তিনি গড়ে তুলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান উৎস প্রকাশন। নাগরীলিপিতে রচিত সাহিত্যসমূহ মরমি সাহিত্য ও বিবিধ মানুষঘনিষ্ঠ উপাখ্যানের বিপুল সন্নিবেশ ঘটেছে নাগরী লিপিতে। এগুলো মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দলিল, যা দীর্ঘসময় অনালোকিত ছিল, অনালোচিত ছিল। নাগরীলিপিতে লিখিত সাহিত্য মূল বাংলা সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপের মতো। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দুটি অতি জনপ্রিয় গান গীত হয়, ‘বন্ধু তোর লাইগা রে তনু জরজর/ মনে চায় ছাইড়া যাইতাম, থুইয়া বাড়িঘর’; এটি সৈয়দ শাহনূরের লেখা, অনেকেরই জানা নেই, এটি রচিত হয়েছে নাগরীলিপিতে। অপর গানটি নাগরীলিপিতে রচিত শীতালং শাহের, ‘দুড়িলে বন্ধুরে পাইবায়, বন্ধু আছইন শ্রীপুর/ আগে চিন মোহাম্মদি নূর। আরও অসংখ্য মরমি সঙ্গীত রয়েছে, পুঁথি বিলুপ্ত হয়ে যাবার পরও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। নাগরীলিপিতে লিখিত হয়েছে সোনাভানের উপাখ্যান, সাত৭ রচনা। সাধারণ মানুষ নাগরী সম্পর্কে না জেনে থাকলেও বিভিন্ন সময়ে এ পুঁথিগুলোর নাম শুনেছে। মোস্তফা সেলিম ইতোমধ্যে এরকম ২৫টি পুঁথি সম্পাদন করে প্রকাশ করেছেন।
×