ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে পৌঁছে দিতে চান সংরক্ষক

৫২ বছর আগে করাচী থেকে কর্মীকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি...

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২২ আগস্ট ২০১৭

৫২ বছর আগে করাচী থেকে কর্মীকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি...

শংকর লাল দাশ বায়ান্ন বছর আগে ১৯৬৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুদূর করাচী থেকে নিজের হাতে চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন পটুয়াখালী মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন সিকদারকে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সে চিঠি কিছুটা অস্পষ্ট আর মলিন হয়ে পড়েছে। তারপরও চিঠিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। আর এ বিবেচনায় চিঠিখানা আজও যতেœর সঙ্গে সংরক্ষণ করে চলছেন জয়নুল আবেদিন সিকদারের ভাইয়ের ছেলে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হারুন অর রশিদ। এছাড়া হারুন অর রশিদের কাছে আরও রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও তার চাচা জয়নুল আবেদিন সিকদারের একাধিক অপ্রকাশিত ছবি। বঙ্গবন্ধুর এসব অমূল্য স্মৃতি হারুন অর রশিদ তার চাচা মরহুম জয়নুল আবেদিন সিকদারের শেষ ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে নিজের হাতে তুলে দিতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। কোনক্রমে এসব স্মৃতি তিনি অন্য কারও কাছে হস্তান্তর করতে রাজি নন। হারুন অর রশিদ (৫৮) পেশায় শিক্ষক। বাড়ি আমখোলা গ্রামে হলেও পরিবার নিয়ে বাস করেন পটুয়াখালী জেলা শহরে। তিনি ১৯৮৯ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন উত্তর আমখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। তার বড় চাচা মোজাফফর সিকদার দীর্ঘদিন আমখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ছোট চাচা জয়নুল আবেদিন সিকদার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম স্নেহধন্য। হারুন অর রশিদের বর্ণনামতে তার চাচা জয়নুল আবেদিন সিকদার ছিলেন তৎকালীন পটুয়াখালী মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক। ছিলেন পটুয়াখালী জেলা বাকশালের সাত সদস্যের অন্যতম। পাকিস্তান আমলে একাধিকবার বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন। স্বাধীনতার পর দলীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য করে বঙ্গবন্ধু তাকে রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যতবার দক্ষিণাঞ্চল সফর করেছেন, প্রতিবারই জয়নুল আবেদিন সিকদার সঙ্গী ছিলেন। ১৯৯২ সালের ১২ ডিসেম্বর জয়নুল আবেদিন সিকদার মারা যান। হারুন অর রশিদ জানান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছোট চাচা জয়নুল আবেদিন সিকদারের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তাঁদের নিয়মিত দেখা-সাক্ষাত হতো। জয়নুল আবেদিন সিকদারের কাছে বঙ্গবন্ধু নিয়মিত চিঠিপত্র লিখে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সংগঠনের খোঁজখবর নিতেন। সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। জয়নুল আবেদিন সিকদারের কাছে বঙ্গবন্ধুর অজস্র চিঠিসহ বহু স্মৃতিবাহী নিদর্শন ছিল। কিন্তু সত্তরের জলোচ্ছ্বাস, একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম ও পঁচাত্তরের বিপর্যয়ে প্রায় সব নিদর্শন হারিয়ে গেছে। কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা একখানা চিঠি আর একাধিক ছবি রয়ে গেছে। চাচা জয়নুল আবেদিন মারা যাওয়ার আগে চিঠি আর ছবি হারুন অর রশিদের হাতে তুলে দিয়ে যান। সেই সঙ্গে নির্দেশনা দিয়ে যান, যেন এগুলো তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে তুলে দেন। যে কারণে এগুলো তিনি সযতেœ রক্ষা করে চলছেন। জয়নুল আবেদিন সিকদারকে লেখা চিঠি বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের প্যাডে নিজ হাতে লিখেছিলেন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে চিঠির কোন কোন জায়গা কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। কাগজ মলিন হয়ে পড়েছে। তারপরও স্বাক্ষরসহ পনেরো লাইনের চিঠির অনেকটাই সাধারণ চোখে পাঠোদ্বার করা সম্ভব হয়েছে। চিঠির হুবহু বর্ণনা- স্নেহের জয়নাল, স্নেহ ও ভালবাসা নিও। যদিও খবরে উঠেছে যে, তুমি ঘঅচ এ যোগদান করেছ। তফাপি সেটা আমি কোনদিন বিশ্বাস করতে পারব না। কারণ যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে তোমার জীবনের সমস্ত পাওনা নষ্ট করেছ, সেক্ষেত্রে ... ঊীলড়ঁপঃষু ত্যাগ করা সম্ভবপর ... ইনশাল্লাহ ফোরকান সাহেব খঅড পাশ করে... আপনার ও...। ...আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করবে। তুমি দৈনিক সংবাদপত্র ‘ইত্তেফাক’ অফিসে প্রতিবাদ লিখে ছাপিয়ে দাও। ইনশাল্লাহ ঘঙঠ/উঊঈ মাসে আমি পটুয়াখালীতে আসব। সকলকে আমার সালাম জানিয়ে দিও। ইতি। শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সালের ১৯ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু এ চিঠি লেখেন। চিঠির ডান পাশের ওপরে ছাপানো রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান, ৬৭৭ ধানমন্ডী রোড, ঢাকা ঠিকানা। যদিও এ চিঠি লেখা হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী থেকে। এ চিঠি প্রসঙ্গে পটুয়াখালী শহরের বাসায় বসে হারুন অর রশিদ জানান, তার চাচা জয়নাল আবেদিন সিকদার ওই সময়ে বেশ বড়মাপের নেতা ছিলেন। একই সময়ে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপের কমিটিতে কে বা কারা জয়নুল আবেদিন সিকদারের নাম অন্তর্ভুক্ত করে ইত্তেফাকে প্রকাশ করে, যা বঙ্গবন্ধুর চোখে পড়ে। এরপরই বঙ্গবন্ধু তার চাচাকে এ চিঠি লেখেন। প্রকৃতপক্ষে তারা চাচা কখনই আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাননি। এ চিঠির এক মাস পর নবেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু পটুয়াখালী আসেন। তার চাচাকে সঙ্গী করে বঙ্গবন্ধু গলাচিপার রাঙ্গাবালী ও বড় বাইশদিয়াসহ কয়েকটি চরদ্বীপ সফর করেন। এর মধ্যে গলাচিপার রামনাবাদ নদীর পশ্চিম তীরের হরিদেবপুর হাই স্কুল মাঠে বিশাল জনসভা করেন। তিনি হাইস্পিড লঞ্চ নিয়ে সফর করেন। ওই সফরের খরচ হিসেবে তার বাবা মমতাজ সিকদার বঙ্গবন্ধুকে নগদ সাড়ে চার শ’ টাকা দিয়েছিলেন। এ চিঠির প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে নেতার সঙ্গে কর্মীর সম্পর্ক এবং সংগঠনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধ, যা যে কাউকে আবেগাপ্লুত করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার চাচা জয়নাল আবেদিন সিকদারসহ আরও কয়েকজনের একটি গ্রুপ ছবি দেখিয়ে হারুন অর রশিদ জানান, ছবিটি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তোলা হয়েছিল। এমন আরও একাধিক ছবি রয়েছে হারুন অর রশিদের সংরক্ষণে। হারুন অর রশিদ জানান, এ ছবি ও চিঠি সংরক্ষণের জন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। চার বছর আগে এসব স্মৃতি তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ই-মেলে তিনি যাবতীয় তথ্য জানিয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোন উত্তর পাননি। ফলে অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হারুন অর রশিদ জানান, চাচার শেষ ইচ্ছা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাতে এসব স্মৃতি তুলে দিয়ে তিনি ভারমুক্ত হতে চান। এর বেশি তিনি কিছুই চান না। সংসারে অভাব-অনটনের মাঝেও আগলে রাখা অমূল্য এসব স্মৃতি জননেত্রীর হাতে তুলে দেয়াই তার জীবনের শেষ লক্ষ্য।
×