ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র হক

শিশুর মনোস্তত্ত্ব শিশুর হাসি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২১ আগস্ট ২০১৭

শিশুর মনোস্তত্ত্ব শিশুর হাসি

দীপিতা নামের শিশুর বয়স ১৮ নবেম্বর দু’ বছর পূর্ন হয়ে তিনের ঘর পা দেবে। মেয়েটি এতটাই কিউট যে শিশু মনোস্তত্ব এখনই রপ্ত করে ফেলেছে। সে মেধার বহির্প্রকাশ ঘটায় বডি ল্যাঙুয়েজ সাইন ল্যাঙুয়েজ সহ নানা মাধ্যমে। সবচেয়ে বেশি প্রকাশ করে অকৃত্রিম মায়াবি হাসি দিয়ে। সেই হাসিতে চোখে মুখে দীপ্ত হয়ে ওঠে মেধার ঝলক । হাসি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি (মনোবিজ্ঞান) বিভাগের প্রফেসর কেল্টার বলেছেন, হাসতে থাকা শিশু ঠিকই জানে স্বতর্স্ফূত মিষ্টি হাসি ভালোবাসার বন্ধন তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। এই হাসিতেই স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করে নেয় অপার সেনহ। যা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে। এমন ইতিবাচক বিষয় মস্তিস্ক ও রাসায়নিক অবমুক্ত হয়। এভাবেই শুরু হয়ে যায় জীবন রসায়ন তৈরির পালা। এই জীবন রসায়ন সারা জীবনের সূচনা। শিশু যত হাসি খুশিতে থাকেব, প্রান খুলে হাসবে ততই তার মেধার বিকাশ ঘটবে দ্রুত। সাইকোলজিস্টগন বলেন, শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ইতিবাচক বিনিময় এক ধরনের মিথস্ক্রিয়াগত নৃত্য। বড়দের হাসির প্রতি উত্তরে শিশু হাসি দিলে বুঝতে হবে তার মস্তিস্কের বিকাশ সুন্দরভাবেই ঘটছে। মা ও শিশুর মধ্যে হাসি বিনিময়ে আছে একটি ছন্দ। যা মনোস্তত্বে সুরের তাল ও লয় এনে দেয়। শিশুর মেধা বিকাশে এই ছন্দের খুবই প্রয়োজন। এই ছন্দ শিশুর মেধা বিকাশের এক অনুরাগও হয়ে আসে। ইউরোপের এক মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর উলরিশ মুয়েলার গবেষণায় প্রমান করেছেন, মা বাবা সন্তানের হাসির উত্তর যদি হাসি মুখে না দেন যদি কোন বিরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ হয় তাহলে শিশুও অভিব্যক্তিহীন হয়ে পড়ে। তখন শিশু বুঝে নেয় তার প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি পড়েছে। শিশুর এই বিষন্নতা পরবর্ত্তী সময়ে তাকে ইন্ট্রোভার্ট করে তোলে। যা শিশু বেড়ে ওঠার পর্যায়ে বড় একটি ক্ষত। এই ক্ষত চলতেই থাকলে তার ফলাফল ভালো হয় না। বিষন্ন মায়ের সন্তানেরা অবিষন্ন মায়ের সন্তানের চেয়ে কম হাসে। শিশুর সুখানুভূতি ও সুখের লক্ষনগুলো প্রকাশ পায় না সহজে। কখনও কম প্রকাশ পায়। কখনও পায়ই না। বিজ্ঞান বলেছে, প্রত্যেক শিশু একশ’ বিলিয়ন নিওরন নিয়ে জন্মগ্রহন করে। এই নিওরনই ¯সাঁইয়ুতন্ত্রে মস্তিস্কে সর্বাধিক বিকাশ ঘটায় তিন বছরে ৮০ শতাংশ। তারপর আট বছর পর্যন্ত ধীর গতিতে বাড়তে থাকে। পাঁচ বছরের মধ্যে বেড়ে যায় ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছর পর পরবর্ত্তী দুই বছরে যোগ হয় মাত্র দশ শতাংশ। আট বছর পর্যন্ত বাড়ে ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৫ বছরের পর পরবর্ত্তী তিন বছরে যোগ হয় মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ। বাকি ২ থেকে ৫ শতাংশ বাড়ে সারা জীবনে। তারপরও অতি মেধাবী ছাড়া ২ শতাংশ কখনও পূরণ হয় না। এই নিওরনই মস্তিস্কে মেধার বিকাশ ঘটায়। নিওরনকে যতেœর সঙ্গে নার্সিং করলে একটি নিওরন ১৫ হাজার নিওরনের সংযোগ ঘটাতে পারে। সংযোগ যত শক্ত হয় ধী শক্তি ততই বেড়ে যায়। শিশু জন্মের পর আট বছরের মধ্যে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সার্বিক ব্যবহার বুঝতে পারে এবং ব্যবহার শুরু করে। এই ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারও ৮০ শতাংশ ঘটে জন্মের তিন বছরের মধ্যেই। একই সময়ে শিশু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বা ‘সিকসথ্ সেন্স’ অনুভব করতে পারে বা বুঝতে পারে এবং প্রয়োজনে অটোমেটিক ব্যবহার হয়। কি ভাবে বেড়ে উঠছে আমাদের প্রজন্মের শিশুরা! এই যে নিওরণ এবং ইন্দ্রিয় যার পূর্ন বিকাশ ঘটে প্রথমে মা বাবা তারপর আপনজনদের ঘিরে। মনোবিজ্ঞানীগনের কাছে সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় চাইল্ড সাইকোলজি বা শিশু মনোস্তত্ব। শিশুর মনোস্তত্ব প্রথমে বোঝার ক্ষমতা রাখে মা। তার অনেক পরে বাবা। মানব জন্মের প্রক্রিয়ায় নারীর শিশু ধারণ করার থলিতে (ইউটেরাস) কোটি কোটি রক্ত বিন্দু দিয়ে যে মানব বেড়ে ওঠে তার প্রথম খোঁজ রাখে মা। সেই মানব শিশুর চোখে পৃথিবীর আলোক রশ্নী পড়ার সঙ্গেই কেঁদে ওঠে। শিশুর এই বিস্ময়ের কান্না ও মায়ের আনন্দের হাসি প্রথমে গড়ে তোলে প্রকৃতির ভালোবাসার ভূবন। এই ভূবন মা ও শিশুর হৃদয় থেকে সঞ্চারিত হতে থাকে। শিশু মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় মা ও সন্তানের মধ্যে যে ‘আই কনট্যাক্ট’ বা চোখের সংযোগ ঘটে তাই স্বর্গীয় আলোর এক অনুভূতি। এই আলোক বার্তা দিনে দিনে শিশুর মনোস্তত্ব হয়ে ওঠে। যা বুঝতে ও অনুভব করতে পারে মা। এই জায়গাটিতে বাবার ভূমিকা আপাত দৃষ্টিতে গৌন মনে হতে পারে। তবে শিশু মায়ের পরই খুঁজতে থাকে বাবাকে। ওই সময়টিতে বাবা কাছে না থাকলে সন্তানের সঙ্গে বাবার একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। যা শিশুর বিকাশ ও সুন্দর পথ সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মেধার এই বিকাশ দ্রুত ঘটে যখন কাছের আতœীয় স্বজন শিশুর পাশে থাকে। বিশেষ করে দাদা দাদী নানা নানী। খালা ফুপু চাচী মেধার বিকাশে সহযোগী হয়ে আসে। শিশু মা বাবার পরই প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়তে থাকে নানী দাদীর দিকে। তারপর দাদা নানার দিকে। তারপর অন্যান্য স্বজনের দিকে। এই সময়ে শিশুকে যদি মুক্ত করা না যায়, কোন কারনে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হয় অথবা নেগেটিভ এ্যাটিচ্যুড শো করা হয় তা শিশুর মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। শিশু জন্মের পর থেকে অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত মা ও বাবাকে সময় মতো কাছে না পায় তার মনের মধ্যে একাকিত্বের প্র”ছন্ন ধারা চলে আসে। এই একাকিত্বও মেধা বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। শিশু যত হাসি খুশিতে থাকেব, প্রান খুলে হাসবে ততই তার মেধার বিকাশ ঘটবে দ্রুত। বর্তমানের শিশুরা একবিংশ শতকের। জন্মের পরই সে ঘরে দেখে আধুনিক যন্ত্র। বেড়ে ওঠে মোবাইল ফোন রঙিন টেলিভিশন কেবল সংযোগ সহ বিনোদনের নানা উপকরনে। যাদের মা বাবা উভয়ই চাকরি করেন শিশু দিনের অনেকটা সময় মা বাবার সান্নিধ্য বঞ্চিত হয়। ছুটির দিন ও নির্দিষ্ট সময় ছাড়া শিশু মা বাবাকে কাছে পায় না। একটা সময় ছিল একান্নবর্ত্তী পরিবার। তারপর কিছুটা ভেঙ্গে একই পরিবারের সকল সদস্য এক সঙ্গে থাকার পালা। তারপর হাড়ি ভিন্ন হলেও পাশাপাশি বাড়িতে অব¯’ানে স্বজনদের মধ্যে আতœীয়তার সমন্বয়। সেই সময়গুলোতে শিশু বেড়ে ওঠার পর্যায়ে তার আশেপাশে স্বজনদের কাছে পেতো। গল্পের ছন্দে শিশু বেড়ে উঠতো সুন্দর ছন্দের মানসিকতায়। বর্তমানে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হওয়ায় শিশু বেশিরভাগ সময় নিকটজনদের কাছে পায় না। মধ্যবিত্ত পরিবারে ‘কাজের লোক’ শিশুর দেখভাল করে। উ”চবিত্ত পরিবারগুলোতে ‘গভর্নেন্স’ রাখা হয়। অর্থাৎ যে ভাবেই হোক শিশু বেড়ে ওঠে অপরিচিতের কাছে। তারা নিকটজনের মতো আপন হতে পারে কি? আগামীর শিশু কি ভাবে বেড়ে উঠছে তা মা বাবা ও পরিবারের স্বজনদের ভাবার সময় এখনই।
×