ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল হক খান

আরও একটি রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২১ আগস্ট ২০১৭

আরও একটি রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি

একাত্তরের পরাজিত শত্রু ’৭৫-এ নিল প্রতিশোধ। ১৫ আগস্ট’ ’৭৫ জাতির পিতাকে হত্যার পর তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, এম মনসুর জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করে ৩ নবেম্বর। বাঙালী জাতি এখনও বয়ে বেড়ায় সেই শোকের পাথর। এসব হত্যাকা- নিছক হত্যাকা- নয়, একটা জাতির আদর্শকে, স্বপ্নকে হত্যা করা, জাতিকে মেধাহীন করা, রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করা, যাতে আওয়ামী লীগ আর কোনদিন ঘুরে দাঁড়াতে না পারে, ক্ষমতায় আসতে না পারে। গভীর ষড়যন্ত্রটি ছিল বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের মূলনীতি ও কাঠামোকে ধ্বংস করা। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানী ভাবধারায় ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এজন্যই বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর তারা সর্বপ্রথম আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা, জেল-জুলুমের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার কাজে হাত দেন। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার চক্র এবং তাদের দোসররা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। তাই শুরু করে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগেও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ’৮৭ সালের ১০ নবেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সচিবালয়ের সামনে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ কর্মী নূর হোসেন মারা যায়। ’৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে নেত্রীকে বাঁচায়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০০০ সালের ২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রাখা হয়েছিল। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে দুই কিলোমিটার জায়গা ঝলসে যেত। এছাড়াও আরও কয়েকবার তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে তিনি বারবার বেঁচে যান। তবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাসের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাটি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশ এক সন্ত্রাসের রাজ্যে পরিণত হয়। শুরু হয় চারদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। বগুড়ার কাহালুতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক আটক, ঢাকার উত্তরা ও কুড়িলে বিএনপি নেতার কাছ থেকে অত্যাধুনিক রাইফেল উদ্ধার, চট্টগ্রামে ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের জেটি থেকে বৃহত্তর অস্ত্র, গ্রেনেড ও গুলির চালান ধরা পড়ার পর মাঝপথে তদন্ত থেমে যায়। এই অস্ত্রের চালান থেকেই হয়তবা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গ্রেনেড সরিয়ে ফেলা হয় এ হত্যাকা-ে ব্যবহারের জন্য। জোট সরকার ২ ডিসেম্বর ২০০১ সালে শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পথ সুগম করে দেয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশটি ছিল পূর্ব নির্ধারিত। সমাবেশের পর সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৮ জন। আইভি রহমান, জিল্লুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমীর হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, মেয়র হানিফসহ অনেক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। ২৪ আগস্ট আইভি রহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। শেখ হাসিনা ছিলেন প্রধান নিশানা। হত্যার ছক থেকে এটা সুস্পষ্ট। জনসভায় বোমা ও গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং অবিরাম গুলিবর্ষণ দ্বারা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। হামলাটি ছিল অনেকটা মিলিটারি কমান্ডো স্টাইলের। ছকটি ছিল নিখুঁত। কোন কারণে যদি গ্রেনেড হামলা ব্যর্থ হয় তবে গুলি করে গাড়িতে তাকে হত্যা করা হবে। বাস্তবিক অর্থেও দেখা যায় শেখ হাসিনা ভাষণ শেষ করেন ৫টা ২২ মিনিটে। ভাষণ শেষ হওয়ার এক-দেড় মিনিটের মধ্যেই শুরু হয় গ্রেনেড বৃষ্টি। গ্রেনেড হামলা শুরু হওয়া মাত্র নিরাপত্তারক্ষী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তার চারপাশে মানবপ্রাচীর তৈরি করে বুলেট প্রুফ গাড়িতে নিয়ে যান। ঘাতকরা তাকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে। নেত্রীর জীবন রক্ষার্থে পাশে থাকা দেহরক্ষী মাহবুব গুলিতে নিহত হন। এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পরামর্শ এবং সহায়তা নিয়েই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তার প্রমাণ ২১ আগস্টের জনসভায় শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আশপাশের ভবনগুলোর ছাদে পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকা। সেদিন আশপাশের ভবনগুলোর ছাদে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব পালন করতে না দেয়া। গ্রেনেড হামলার পর পুলিশ কর্তৃক টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের মাধ্যমে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া এবং কয়েকজনের লাশ গুম করে ফেলা। ২১ আগস্ট এই ঘটনার পর কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেনেড পাওয়া। অবিস্ফোরিত গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাতের ছাপ ও আলামত নষ্ট করা। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেনেড পাওয়ার ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সরকার এ হামলার সঙ্গে জড়িত না থাকলে কেন্দ্রীয় কারাগারের কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে গ্রেনেড নিয়ে কারও ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, ৩ নবেম্বর জেলহত্যা এবং ২১ আগস্ট নারকীয় গ্রেনেড হামলা একই সুতোয় গাঁথা। সেদিন তারা ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল ইতিহাসের চাকা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নন, শুধু জাতির পিতার কন্যা নন, একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতীক, বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতীক, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে বাঙালী জাতির আশার আলোর যে প্রদীপটি নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল শেখ হাসিনা সে প্রদীপটিকে জ্বালিয়ে রেখেছেন সযতনে, জাতিকে আঁধার রাতে পথ দেখানোর জন্য। খুনীরা ভাল করেই জানে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে বাঙালী জাতির আলোর প্রদীপকে নিভিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাই তাকে হত্যার জন্যই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাকে ঘিরে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ভূমিকা ছিল জঘন্য। তদন্ত ছাড়াই জোট সরকারের শীর্ষ নেতারা এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী বলে প্রচার করে। কেউ কেউ প্রতিবেশী একটি দেশের ষড়যন্ত্র বলেও অপপ্রচার চালায়। স্বচ্ছ তদন্তের সঙ্গে আন্তর্জাতিক তদন্তের যে দাবি উঠেছিল তা নিয়েও করা হয় মিথ্যাচার এবং ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য জোট সরকারের প্রযোজনায় নির্মিত হয় জজ মিয়া নাটক। কিন্তু সুপার ফ্লপ এ নাটক শেষ পর্যন্ত দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে শুধু হাসির খোরাকই যুগিয়েছে, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত নতুন করে শুরু হয় এবং বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। এ হত্যাকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, অস্ত্র ও গ্রেনেড কিভাবে, কোথা থেকে এসেছে সবকিছুই আজ পরিষ্কার। আমরা আশা করব দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, জনগণের জানমাল রক্ষার্থে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সুষ্ঠু বিচার হোক। প্রকৃত দোষীরা শাস্তি পাক। লেখক : বীমা ব্যক্তিত্ব
×