ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গ

সিনহার অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য সুয়োমোটো এক্সপাঞ্জ দাবি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২০ আগস্ট ২০১৭

সিনহার অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য সুয়োমোটো এক্সপাঞ্জ দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অনেক অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়েছেন উল্লেখ করে ওই সব বক্তব্য সুয়োমোটো এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির দুর্নীতি তদন্তে বাধা দিয়ে প্রধান বিচারপতি অসদাচরণ করেছেন বলেও দাবি করেন তারা। তারা বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি শপথ ভঙ্গ করেছেন। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও আশা তাদের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন প্রণয়নের দাবি জানানোর পাশাপাশি সাংবিধানিক পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়োগ না দিতেও অনুরোধ জানান তারা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর ধানম-িতে ডব্লুভিএ মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এ সেমিনারের আয়োজন করে। নির্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। অন্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন সংগঠনের উপদেষ্টা আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক, সংগঠনের আরেক উপদেষ্টা ও আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সংগঠনের সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, প্রখ্যাত ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনের আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী। নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম জোমাম্মেল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে দেশ স্বাধীন হতো না। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারাও সেই সুযোগ পেতাম না। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজকে প্রধান বিচারপতি একটি মামলার রায়ে সংসদ নিয়ে কটাক্ষ মন্তব্য করেন। এই রায়ের আগেও বিভিন্ন সভা সেমিনারে গিয়ে সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কটাক্ষ বক্তব্য দিয়েছেন। অথচ একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির তদন্ত চলে তখন তিনি বলেন তদন্ত করা যাবে না। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, আপনি একজন চোর বিচারপতির পক্ষ নিয়ে শপথ ভঙ্গ করেছেন। আমি মনে করি এসব কর্মকা-ের পর প্রধান বিচারপতি হিসেবে থাকার আপনার কোন যোগ্যতাই নেই। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্যের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, মামলার সঙ্গে যেসব বিষয়ের কোন সম্পর্কই ছিল না, সে বিষয়েও আপনি মন্তব্য করেছেন। এত এত অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য রায়ে এসেছে প্রধান বিচারপতি একবার চিন্তা করে দেখুন। ওইসব বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার আবেদন করতে হবে কেন, আপনি সুয়োমোটো ভাবেই ওইসব কথা বাদ দিবেন বলে আশা করছি। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই দেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজ তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলোই সমাপ্ত করে যাচ্ছেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হলেই তার রক্তের ঋণ শোধ হবে বলেও মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালী। তার নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা কখনই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আজকে প্রধান বিচারপতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমাদের কিন্তু অনেক ইতিহাসই জানা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিচারপতি সায়েম কিন্তু সামরিক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন। আমরা তা ভুলি নাই। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, রায়ে ৭০ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। বিচারপতিরা রায়ে যা বলছেন আসলে তা সঠিক নয়। এই রায়ের মাধ্যমে বিনা কারণে রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গসমূহের সঙ্গে বিভক্তি সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কোন বিচারপতির রায়ে এমন বক্তব্য থাকা উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। তাকে হত্যার পর সেই বিচারকাজ থামিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে আবার সেই বিচার কাজ শুরু করেছেন। অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে। তবে সংগঠন হিসেবে এখনও জামায়াতের বিচার হয়নি। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিচার না হওয়ায় এখনও তারা ধর্মের নামে হত্যাকা- চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। জামায়াত যতদিন থাকবে ততদিনই ষড়যন্ত্র থাকবে। শাহরিয়ার কবির বলেন, বর্তমানে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একাত্তরের ঘাতকদের সমর্থকরা ছড়িয়ে আছে। আর তার প্রমাণ এই ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রয়েছে। আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে সংসদ এবং রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচমেন্ট করার ক্ষমতাও সংসদের হাতেই রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রায়ের অপ্রাসঙ্গিক কিছু শব্দ বাদ দিতে রিভিউ করতে। তবে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে দু’একটা শব্দ এক্সপাঞ্জ করে গোটা রায়কে বৈধতা দিলে জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। সংবিধান জনগণকেই সকল ক্ষমতা দিয়েছে। জিয়াউর রহমান যে ভাবে জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল এ রায়েও ঠিক একই কাজ করা হয়েছে। বিচারকরা তাদের বিচার করলে ন্যায় বিচার কিভাবে হবে, প্রশ্ন করেন তিনি। এ রায়ে আইনের শাসন লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। শাহরিয়ার কবির তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন প্রণয়নের দাবি জানানোর পাশাপাশি সাংবিধানিক পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়োগ না দেয়ার অনুরোধ জানান। বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক তার বক্তব্যে বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের মাধ্যমে দেশকে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি ইতিহাস জানেন না, তাই লিখতে সাহস পেয়েছেন। একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি এটা তিনি লিখলেন কিন্তু কার নেতৃত্বে স্বাধীন হলো এটা লিখলেন না। রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এসেছে। তাই শুধু কয়েকটি বক্তব্য এক্সপাঞ্জের নয় পুরো রায়টাই রিভিউ করতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে আপীল বিভাগের এই সাবেক বিচারপতি বলেন, আপনি রায়ে আচরণবিধি দিলেন, সেখানেই কিন্তু আছে কোন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করা যাবে না। তাহলে কোন আইনে আপনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন? কোড অব কন্ডাক্টে আপনিই লিখেছেন মামলা সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত করা যাবে না, আবার আপনিই সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করলেন। প্রধান বিচারপতি তার চেয়ার কলঙ্কিত করছেন দাবি করে তা আর কলঙ্কিত না করতে পরামর্শ দেন সাবেক এই বিচারপতি। আপীল বিভাগের আরেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, এই শোকের মাসে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর ওপরে আলোচনা করব, সেখানে সুপ্রীমকোর্টের একটি রায়ের কারণে প্রধান বিচারপতির বিষয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে, এটা আমাদের দুরভাগ্য। ষোড়শ সংশোধনী মামলায় প্রধান বিচারপতি রায়ের যে অংশটুকু লিখেছেন তা পড়ে মনে হচ্ছে পুঁথি পাঠ করছি। পড়তে গিয়ে আরও একটা বিষয়ে সামনে এসেছে এটা কি তিনিই লিখেছেন নাকি অন্য কেউ। তিনি বলেন, রায়ে তিনি বলেন বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি, তাহলে কার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে গোলাম আযমের নেতৃত্বে? তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি এসব বলতে পারেন। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থক। প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অসংখ্য অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়েছেন তাই তার শপথ ভঙ্গ হয়েছে বলে দাবি করেন বিচারপতি মানিক। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও আশা করেন আপীল বিভাগের এই সাবেক বিচারপতি।
×