ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষছায়াপথ

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২০ আগস্ট ২০১৭

তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষছায়াপথ

মোরসালিন মিজান ॥ খুব বেশি সময় পাননি সেলিম আল দীন। তবে যেটুকু পাওয়া তার পুরোটাই কাজে লাগিয়েছেন। অন্যের চর্চা থেকে বের হয়ে এসে শেকড়ের সন্ধান করেন তিনি। কোন একটি ফর্ম বা কনটেন্টে বেশিদিন স্থির থাকেননি। বরং সাহস দেখিয়েছেন। ভাংচুরের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। এভাবে বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণে প্রয়াসী হন তিনি। ক্ষণজন্মা নাট্যকারের ৬৮তম জন্মদিন ছিল শুক্রবার। এ উপলক্ষে বরাবরের মতোই আয়োজন করা হয়েছে সেলিম আল দীন উৎসবের। ‘তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ’ স্লোগানে উৎসবের আয়োজন করেছে ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার, সেলিম আল দীন ফাউন্ডেশন, ভোর হলো এবং শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত ছয় দিনব্যাপী উৎসবে নাটক মঞ্চায়ন ছাড়াও থাকছে সেমিনার, আলেখ্যানুষ্ঠান, ছবি আঁকা পদক প্রদানসহ নানা আয়োজন। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীনকে যেমন স্মরণ করা হচ্ছে, তেমনি নিজস্ব চর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা নাটককে এগিয়ে নেয়ার অঙ্গিকার করছেন নাট্যকর্মীরা। প্রথম দিন সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব মোটামুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় পরদিন শনিবার। মূল মিলনায়তনে উৎসবের উদ্বোধন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এবারের উৎসব প্রসঙ্গে প্রয়াত নাট্যকারের বন্ধুজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, সেলিম আল দীন আমাদের দেশের, আমরা মনে করি, আমাদের কালের মহান নাট্যকার। এই জন্য যে, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত জাতির নিজস্ব জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার নাট্যরীতির আলোকে বাংলা নাটক নির্মাণ করেছিলেন। তিনি তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেছিলেন যে, বাঙালীর নাট্যরীতি হাজার বছরের। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ঔপনিবেশিকতাকে ঝেড়ে ফেলা জরুরী ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কাজটি আমরা সম্পন্ন করতে পারিনি। সেলিম আল দীনের নেতৃত্বে কাজটা শুরু হয়েছিল। গ্রাম থিয়েটার ঢাকা থিয়েটারসহ বিভিন্ন দল জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের কাজে ব্রত ছিল। কিন্তু এখন সেলিম নেই। এটা আমাদের জন্য জটিল সময়। তিনি নাট্যকার ও গবেষক ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশের প্রতি সংস্কৃতির প্রতি ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ছিলেন। সর্বপ্রাণবাদীতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি নাটকে প্রান্তিক মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছেন। শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির যে বাণী, নাটক আকারে তুলে ধরেছিলেন তিনি। মানুষের কথা বলেছেন। প্রকৃতির কথা বলেছেন। এভাবে বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন তিনি। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই উৎসবের আয়োজন বলে জানান তিনি। অন্য বক্তারাও সেলিম আল দীনের দেখানো পথে নাট্য চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এ বছর সেলিম আল দীন পদক পেয়েছেন নাট্যজন আলী যাকের, মীর মকসুদ-উস-সালেহীন। বজলুল করিম পদক পেয়েছেন লিয়াকত আলী লাকী এবং ফওজিয়া ইয়াসমিন। শিবলী পদক পেয়েছেন নাট্য নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী। অভিনেতা আলী যাকের অনুপস্থিত থাকলেও, বাকিদের হাতে এদিন পদক তুলে দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে ছিল নাট্য প্রদর্শনী। এদিন মঞ্চস্থ হয় সেলিম আল দীনের খুব উল্লেখযোগ্য নাটক ‘ধাবমান।’ ঢাকা থিয়েটারের নাটকে অভিনয় করেন শিমুল ইউসুফ, এশা ইউসুফ, শহীদুজ্জামান সেলিম প্রমুখ। মাঝখানে অনেকদিন বিরতির পর মঞ্চে আসে অন্যান্য সাধারণ প্রযোজনা। ফলে বাড়তি কৌতূহল নিয়ে নাটকটি দেখতে এসেছিলেন দর্শক। সংলাপের পাশাপাশি সঙ্গীত ও নৃত্য নাটকের বক্তব্যকে জোরালো করে। হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। নাটকের পটভূমি হয়ে আসে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিরিসিরি দুর্গাপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও প্রিয় সোমেশ্বরী নদী। বাঙালী এবং গারো সম্প্রদায়ের প্রান্তিক মানুষের জীবনালেখ্য হয়ে ওঠে ‘ধাবমান’। রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা টানাপোড়েন, দুই জাতির দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থান, পারস্পরিক সহমর্মিতা নাটকে দৃশ্যমান হয়। এভাবে আনন্দঘন শুরু আর বিষাদে শেষ হয় ‘ধাবমান’র গল্প। আয়োজকরা জানান, উৎসবের দ্বিতীয় দিনে আজ রবিবার কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটার মঞ্চস্থ করবে নাটক ‘চন্দ্রবাতী কথা’। প্রায় একই সময় স্টুডিও থিয়েটারে বঙ্গলোক মঞ্চস্থ করবে ‘রূপচান সুন্দরীর পালা’। তৃতীয় দিনে সোমবার জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে থাকবে সেলিম আল দীনের বিখ্যাত নাটক ‘নিমজ্জন’। ঢাকা থিয়েটার নাটকটি মঞ্চস্থ করবে। চতুর্থ দিনে মঙ্গলবার একই মঞ্চে ‘স্বপ্নরমণীগণ’ মঞ্চস্থ করবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। সমাপনী দিনে বুধবার মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মঞ্চে আসবে ‘নীলাখ্যান’ নাটকটি নিয়ে। এদিকে, সেলিম আল দীন স্মরণে তিন দিনব্যাপী জন্মোৎসবের আয়োজন করেছে স্বপ্নদল। উৎসবের দ্বিতীয় দিন শনিবার শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে ‘সেলিম আল দীনের নাট্যদর্শন তথা বাংলা নাট্যরীতি প্রসারে প্রতিবন্ধকতা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক বক্তব্য প্রদান করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন উৎসবের আহ্বায়ক ও স্বপ্নদলের প্রধান সম্পাদক জাহিদ রিপন। সন্ধ্যা ৭টায় স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় স্বপ্নদল প্রযোজনা একক-অভিনয়ে মনোড্রামা ‘হেলেন কেলার’। শেষ দিন আজ রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারে সেলিম আল দীনের কালজয়ী সৃষ্টি ‘হরগজ’ মঞ্চস্থ হবে।
×