ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

স্বরূপকাঠির শত পরিবার মরিচ চাষে স্বাবলম্বী

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ২০ আগস্ট ২০১৭

স্বরূপকাঠির শত পরিবার মরিচ চাষে স্বাবলম্বী

স্বামী জমিতে চাষাবাদ করে। ঘরে দুটি ছেলেমেয়ে। আছে বৃদ্ধ শ্বশুর। পাঁচ সদস্যের পরিবার সুসমা দাশের। স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। টানাপড়েন লেগেই থাকে। সুসমার ঘরের আশপাশে জায়গা ছিল। জায়গাগুলো ফাঁকাই ছিল। প্রতিবেশী দেবজিত দাশ বোম্বাই মরিচের চাষ করত। একদিন সুসমা সেখান থেকে চারা নিয়ে আসেন। ঘরের পাশেই লাগিয়ে দেন। এরপর গল্পটা শুধু এগিয়ে যাওয়ায়। একটা বোম্বাই মরিচের গাছ থেকে এখন সংখ্যা হাজারটা। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাছের যতœ নেন। আয় যা হয় তা সংসারে ব্যয় করেন। আবার একটু আধটু সঞ্চয় ও করেন। সুসমার পরিবারটি এখন অর্থনীতিকভাবে সচ্ছল। অভাব অনটন নেই। বোম্বাই মরিচ চাষ করে তারা স্বাবলম্বী। রিপন ছিলেন দিনমজুর। একদিন কাজ আছে তো আরেক দিন নেই। তিনি এখন একজন সফল বোম্বাই মরিচ চাষী। বোম্বাই মরিচ চাষ করে স্বাবলম্বী। ২০০৫ সালে তিনি এক বিঘা জমি লিজ নেন। সমিতির লোনের টাকায়। প্রথমবার লাভ হয় বিশ হাজার টাকা। এবার তিনি দশ বিঘা বেশি জমিতে বোম্বাই মরিচ চাষ করেছেন। তার দেখাদেখি অনেকেই বোম্বাই মরিচ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। বানারী পাড়ার রায়ের হাট থেকে কুড়িয়ানা সড়কের পাশে তার বোম্বাই মরিচের ক্ষেত। দেখলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। কিছু গাছে লাল টকটকে, কিছু গাছে গাড় সবুজ রঙের মরিচ ঝুলে আছে। এত মরিচ, যেন গাছের পাতার চাইতেও বেশি। রিপন জানান, এক বিঘা জমিতে রোপণ করা হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার চারা। গড়ে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ১৫ দিন পর পর মরিচ তুলে বাজারজাত করা হয়। পাইকারি ক্রেতাদের কাছে প্রতি হাজার মরিচ ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানা যায়। পিরোজপুর জেলার আটঘর কুড়িয়ানা মূলত পেয়ারার জন্য বিখ্যাত। এখন সেখানকার কৃষকরা বোম্বাই মরিচ উৎপাদনে রেকর্ড করেছেন। ২০১৬ তে স্থানীয় কৃষি বিভাগ যা অনুমান করেছিল। তার চেয়ে অনেক বেশি বোম্বাই মরিচ এখানে উৎপাদিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, এবার মরিচ উৎপাদনের বাজার মূল্য চার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২৮টি গ্্রামের শত শত মানুষ বোম্বাই মরিচের চাষাবাদ করছে। গৃহিণীরা ঘরের কাজ তো সামলানই, সঙ্গে বোম্বাই মরিচের আবাদ করে অর্থ উপার্জন করছেন। যা সংসারে সচ্ছলতায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মাদ্্রা, আতা, আতাবাড়ি, মাহমুদকাঠী, ব্্রাহ্মণকাঠী, জিন্দাকাঠী, আরামকাঠী, সুলতানপুর, নান্দুহার, গগন, জিলবাড়ি, বলদিয়া, সুটিয়াকাঠী, হরিহরকাঠী, সঙ্গীতকাঠী সোহাগদল, আটঘর, কুিড়য়ানা, রায়েরহাট ইত্যাদি গ্রামে বোম্বাই মরিচের চাষ বেশি হচ্ছে। মরিচ চাষী মনির হোসেন জানান, ঢাকার কারওয়ানবাজারে অধিকাংশ মরিচ সরূপকাঠী থেকে যায়। এখানকার মরিচের মান উন্নত। যেমন ঘ্্রাণ তেমন ঝাল। সারাদেশেই সরূপকাঠীর বোম্বাই মরিচের সুখ্যাতি রয়েছে। প্্রতিদিন ৯/১০ ট্্র্যাক বোম্বই মরিচ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। লঞ্চে করে মরিচ ঢাকায় পাঠানো হয়। পেয়ারা গাছের মধ্যে, শাক সবজির মাঝে, জমির আইলে, বাড়ির আঙ্গিনায়, রান্না ঘরের পাশে, বসত বাড়ির পিছনে বোম্বাই মরিচের চাষ হচ্ছে। খুব যতœ আত্তি লাগে না। সল্প সময়ে ফসল আসে। তাই বাড়তি আয়ের উৎস হতে পারে মরিচের চারা রোপণ। আবার বাণিজ্যিকভাবে ও বোম্বাই মরিচের চাষ অত্যন্ত লাভজনক। রংকুরা গ্্রামের সুশীল ১২ শতাংশ জমিতে মরিচের চাষ করেন। খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। এরই মধ্যে লক্ষাধিক টাকার মরিচ বিক্রি করেছেন বলে জানা যায়। মুসলিম পাড়া, জিন্দাকাঠী, আটঘর, কুড়িয়ানা, আলতা গ্্রামে ফয়জুল হক ব্্িরজের কাছে বোম্বাই মরিচের হাট বসে। পাইকাররা এখান থেকে মরিচ কিনে নিয়ে যান। প্রতি পিস বোম্বাই মরিচ দেড় থেকে দুই টাকায় বিক্রি হয়। তবে সময়ভেদে এই দাম কম বেশি হতে পারে। বোম্বাই মরিচের ব্যবহার বহু রকম। দেশে অনেক কোম্পানি বোম্বাই মরিচের আচার বাজারজাত করে। সিলেটে উৎপাদিত বোম্বাই মরিচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হচ্ছে। বোম্বাই মরিচ রফতানিতে কোন বাধা নেই। এসব কারণে বোম্বাই মরিচের চাহিদা রয়েছে দেশে এবং দেশের বাইরে। শুধু স্বরূপকাঠী এলাকা নয়, সারাদেশেই বোম্বাই মরিচের চাষাবাদ হতে পারে। সেটা এককভাবে কিংবা অন্য ফসলের সঙ্গে। বাঙালীর রসনা বিলাসের অনুষঙ্গ বলে নয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে বোম্বাই মরিচ উৎপাদনে প্রচুর সম্ভাবনা বিদ্যমান। প্রচার প্রচারণা নেই। সে কারণে সম্ভাবনাময় বোম্বাই মরিচের চাষাবাদের ব্যাপকতা বাড়ছে না। এ জন্য উপজেলা পর্যায়ের কৃষি অফিসগুলো তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকদের ভাল উন্নতজাতের চারা সরবারহ, রোগ বালাইয়ের ওষুধপত্র সম্পর্কে জানাতে পারে।
×