ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এস এম মুকুল

কোরবানি হোক দেশীয় পশুতে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২০ আগস্ট ২০১৭

কোরবানি হোক দেশীয় পশুতে

ভারতীয় আগ্রাসনে দেশী পশু সম্পদ আর মাংসের বাজার অস্থির হয়ে উঠার দিন বুঝি শেষ হতে যাচ্ছে। কারণ দেশে গো-মাংস এবং কোরবানির চাহিদা পূরণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। এবছর আশা করা হচ্ছে দেশীয় পশুতেই মিটবে কোরবানি চাহিদার ৯৬ শতাংশ। এ স্বনির্ভরতা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য আশাব্যঞ্জক বার্তা। কেননা একসময় ভারতের গরু ছাড়া দেশে কোরবানি এবং মাংসের চাহিদা পূরণের কথা ভাবাই যেত না। গত একদশকে এই পরিবর্তন- দেশের গবাদিপশু খামারিদের মাঝে নতুন আশা জাগিয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে- ঈদ সামনে রেখে সব ধরনের পশু স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কোরবানির জন্য উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। এজন্য গ্রাম পর্যায় থেকে শহর সব জায়গাতেই খামারিদের তালিকা করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক তাদের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সবাই কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে দেশীয় পশুকে অগ্রাধিকার দিলে এর সুফল পাব আমরাই। বিভিন্ন তথ্যের আলোকে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে গরু আমদানি বাবদ প্রতিবছর ৬০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় অথচ গরু-মহিষ লালন পালনের কাজে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে দেশের চাহিদা পূরণ করে মাংস ও পশুর বর্জ্য রফতানি করে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানো যায়। স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নবযাত্রা ভারত গরু রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে ২০১৪ সাল থেকেই কোরবানির পশুর চাহিদা দেশীয়ভাবে মেটাতে বাড়তি পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ সরকার। বিএসএফএর নির্বিচার গুলি আর অত্যাচার সীমান্তের মানুষদের চোখ খুলে দিয়েছে। সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম ছাড়াও এ বছর মফস্বল অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি পরিবার যেন এক একটি খামার। সচ্ছল ও অসচ্ছল প্রতিটি পরিবারেই একাধিক গরু পালন করা হচ্ছে। জানা গেছে- গত দু-বছরে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ থাকার ফলে দিনাজপুর অঞ্চলে ছোট বড় অসংখ্য পশুর খামার গড়ে উঠেছে। খামারিরা গরুকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি মোটাতাজাকরণে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। সরকারের পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক খামারিদের দেয়া হয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা । গো-খাদ্য সহজলভ্য করতেও নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। উৎপাদনশীল গাভী ও বকনা বিপণন ও জবাই রোধে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন বাড়ানো ও বাচ্চার মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে মাঠপর্যায়ে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। দেশের গরু পরিপূর্ণ হতে চার-ছয় বছর সময় নেয়। স্বল্প সময়ে উৎ্পাদন বাড়াতে ব্রাজিলের বুল এবং প্রযুক্তি এনে তা ব্যবহারের মাধ্যমে দেড়-দুই বছরের মধ্যে গরু জবাইয়ের উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তফসিলী ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সামগ্রিক পদক্ষেপের ফলে দেশী পশুতে কোরবানির চাহিদা মিটানোর সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আশাকরা হচ্ছে নিবিড় তদারকির মাধ্যমে এ উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিয়ে পশুর মাংস চাহিদার চেয়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব হবে দেশেই। বর্জিত হোক ভারতীয়- সমাদৃত হোক দেশীয় আমরা গো-মাংসের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ইচ্ছার কাছে জিšি§ হয়ে থাকতে পারি না। বরাবরই দেখা যায় কোরবানি নিয়ে সরকার ও জনসাধারণ চিন্তায় থাকেন, তখন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের স্বরূপে আবিষ্কার হয়। ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে গরু, মহিষ বাংলাদেশে পাচার করে। আমরা যখন পশু সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই তখন দেশীয়ও কৃষককে সর্বস্বান্ত করার লক্ষ্যে আবাদে গরু, মহিষ পাচার করে দেশের খামারিদের উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করে। গরু নিয়ে দেশের সঙ্গে ভারতের এই গরুমি খেলা আমরা চাইলেই বন্ধ করতে পারি। আসুন কোরবানির জন্য আমরা সবাই দেশীয় গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলকে প্রাধান্য দিই। প্রথম কয়েক বছর দাম একটু বেশি হলেও অচিরেই দেশে গবাদি পশুর খামারিরা গবাদিপশু উৎপাদনকে চাহিদার চেয়ে উবৃত্ত পর্যায়ে উন্নীত করতে পারবে। আর তখন আরও কম দামে কোরবানির পশু এবং সারাবছর মাংসের চাহিদা ঢের পূরণ করতে পারবে। আমরা জানি দেশী গরুর মাংস, চামড়া, গাভী গরুর দুধ ভাল হয়। সব বিচারে ভারতীয় গরুর চেয়ে দেশীয় গরু সব দিক থেকেই ভাল। দেশে গত বছর কোরবানির ঈদে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ পশু জবাই হয়। ধারণা করা হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক না হলে চলতি বছর কোরবানি ঈদে পশুর চাহিদা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। সে হিসেবে এবার কোরবানির জন্য পশু প্রয়োজন হবে ১ কোটি ২০ লাখ। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সারাদেশে গরু-মহিষ ও ছাগল- ভেড়া রয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি। তবে কোরবানির উপযোগী পশুর মধ্যে রয়েছে- গরু ও মহিষ ২ কোটি ৩৮ লাখ এবং ছাগল-ভেড়া ২ কোটি ৬০ লাখ। কোরবানির ঈদে সরবরাহের জন্য দেশের বাজারে প্রস্তুত রয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু। যা কোরবানি ঈদে সম্ভাব্য চাহিদার প্রায় ৯৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সহজাত হিসাবটি হলো, অধিক সংখ্যক দেশীয় গরু উৎপন্ন হলে দেশের মানুষ কম দামে গরুর মাংস পাবে, তেমনি পশুর বর্জ্য ও চামড়া রফতানি আয় বাড়বে। তাই দেশের স্বার্থে প্রতিবেশী ভারত থেকে গরু বোঝাই ট্রাক আসুক কোনভাবেই আমরা তা প্রত্যাশা করি না। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও পশুর উচ্ছিষ্ট থেকে রফতানি আয় বাড়াতে পশু সম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই। আশা জাগাচ্ছে দেশীয় খামার সারাবছর গরুর মাংসের চাহিদা থাকলেও কোরবানির ঈদে বেড়ে যায় গরুর চাহিদা। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- শুধু কোরবানির ঈদকে উপলক্ষ করে কোরবানির পশু, পশুর চামড়াসহ অন্য খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কোরবানির ঈদে। ঈদ-উল-আযহায় কি পরিমাণ পশু কোরবানি হয় তার সুনির্দিষ্ট হিস্যা না থাকলেও বাণিজ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে ৪০ লাখ গরুসহ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ পশু কোরবানি হয়ে থাকে। আশার খবর হচ্ছে- ভারতীয় গরু আমদানিতে সীমান্তবর্তী রাজশাহী, যশোর, খুলনা, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৩১টি করিডরের ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার সরাসরি গবাদি পশু পালনের সঙ্গে জড়িত। দেশে ৬০ শতাংশ গরু পালন করা হয় কুষ্টিয়া, যশোর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলায়।
×