ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহনেওয়াজ চৌধুরী

তাকাতে হবে চলচ্চিত্রের দিকেও

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২০ আগস্ট ২০১৭

তাকাতে হবে চলচ্চিত্রের দিকেও

আমাদের চলচ্চিত্রের রয়েছে সোনালি অতীত। এর পেছনে আমাদের শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচারের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি আমাদের প্রযোজক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী, প্রদর্শকদেরও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। যে যাই বলুক, সিনেমা হলে গিয়ে দর্শকদের সিনেমা উপভোগের আগ্রহ এখনও কমে যায়নি- এ কথা হলফ করে বলতে পারি। কেননা, প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন; ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে সিনেমা দেখার মজা এক রকম আর সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগের মজা আরেক রকম। তাই নতুন নতুন ভাল সিনেমার আবেদন এখনও অনেক। ভাল সিনেমা বলতে আমরা কী বুঝি? একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে বলতে পারি- যে সিনেমা দর্শককে পরিপূর্ণ বিনোদন দিতে পারবে, সেটিই ভাল সিনেমা। খুব গুরুগম্ভীর কাহিনী হলেই যে সেই সিনেমা ভাল হবে, এমন কোন কথা নেই। সিনেমা বিনোদনের মাধ্যম। বিনোদনই মূল কথা। আমাদের সিনেমা পরিপূর্ণ হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশেষ পর্যায়ে উন্নীত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিএফডিসি দাঁড় করালেন। আমাদের চলচ্চিত্র প্লাটফর্ম পেল। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল। নির্মাণ হতে থাকল একের পর এক সিনেমা। সেসব সিনেমার অনেক এখনও দর্শক চাহিদা তুঙ্গে। এর কারণ দর্শকপ্রিয়তা। চলচ্চিত্র জাতিকে প্রগতিশীল করে তোলে। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমা বিনোদনে ভরপুর। অন্য অভিনয় শিল্পীদের সঙ্গে রওশন জামিল, খান আতাউর রহমানের অনবদ্য অভিনয় পুরো সিনেমাটিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর এই চলচ্চিত্রটি চলাকালীন সিনেমা পর্দা থেকে চোখ অন্যদিকে সরবে না। এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার প্রেরণা দেয়। ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে চাষী নজরুল ইসলাম দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নির্ভর এই সিনেমাটি আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। আজিজুর রহমান যে সময়ে ‘ছুটির ঘণ্টা’র মতো আধুনিক গল্পের সিনেমা নির্মাণ করেছেন, তেমন আধুনিক গল্পের ছবি এখনও খুব কমই নির্মিত হয়। প্রযোজক-নির্মাতাদের এমন গল্পের ছবি নির্মাণের সাহস নেই বললেই চলে। এসব সিনেমা কেবল নির্মাতার জন্য সফল হয়নি। শিল্পী-কলাকুশলীদেরও বেশ পরিশ্রম মিশে আছে এসব সিনেমার সাফল্যের পেছনে। তখন এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। প্রযুক্তিও আধুনিক ছিল না। সেই অপ্রতুল পরিস্থিতিতে যদি একেকটি সফল সিনেমার হাত ধরে রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, জসিম, ফারুক, রাজিব, আহমেদ শরীফ, হুমায়ূন ফরিদী, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সুচন্দা, শাবানা, কবরী, রোজিনা, অঞ্জনা, ববিতা, চম্পা, সালমান শাহ সুপারস্টার হতে পারেন, তাহলে এখনকার অভিনয় শিল্পীদের যুগে এত সুযোগ-সুবিধা, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন থাকা সত্ত্বেও সুপারস্টার হতে কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে কেন? একাগ্রতা, মনোযোগ, পরিশ্রম, সততা থাকলে ওপরওয়ালা নিজ থেকে জনপ্রিয়তা হাতে তুলে দেন। এসবের বিকল্প নেই। উপরোল্লিখিত অভিনয় শিল্পীদের উত্তরসূরি হিসেবে হালের কজন অভিনয় শিল্পীর নামোল্লেখ করতে পারব আমরা? কয়টা সিনেমাই-বা মনে রাখার মতো? কিন্তু এই প্রজন্মের দর্শকদেরও পুরনো সিনেমাগুলোর প্রতি আগ্রহ দেখা যায়? এর কারণ কী? সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে খ্যাতিমান, শ্রদ্ধেয় অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে কটূক্তি করে বসেন এই প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীরা। অবাক ও হাস্যকর কা-! কোথায় গুণী শিল্পীদের অবস্থান আর কোথায় তাদের সবে পথচলা! এক-দুটি সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা পেলেই বড় অভিনয় শিল্পী হওয়া যায় না। গুরুভক্তি না থাকলেই বা কিভাবে বড় হওয়া যায়? আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীদের মনে রাখতে হবেÑ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যতদিন বেঁচে থাকবে, এখন থেকে ১০০ বছর পরের প্রজন্মও রাজ্জাক, সোহেল রানা, আলমগীর, জসিম, ফারুক, রাজীব, আহমেদ শরীফ, হুমায়ূন ফরিদী, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সুচন্দা, শাবানা, কবরী, রোজিনা, অঞ্জনা, ববিতা, চম্পা, সালমান শাহদের মনে রাখবে। কারণ, তাদের অভিনয় গুণ। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীদের উচিত এই গুণী শিল্পীদের নামের পাশে নিজের নাম যুক্ত করার প্রচেষ্টায় ব্রত হওয়া। কূটকৌশল করে কে কবে বড় শিল্পী হতে পেরেছে? ইদানীং যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়ে বাংলাদেশের অভিনয় শিল্পী, কলাকুশলীরা নানা আপত্তি জানাচ্ছেন। হল মালিকদের সঙ্গে বিরোধ চলছে। এসব সমস্যার সুনির্দিষ্ট সমাধান কাম্য। যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলোতে এপার বাংলার অভিনয় শিল্পীরা অভিনয় করলেও তাদের ভূমিকা খুবই ক্ষীণ মনে হয়। এ ধরনের সিনেমায় নিয়ম-নীতির পালনের নামে এপার বাংলার মাত্র দু’-একজন অভিনয় শিল্পীকে নামকাওয়াস্তে নেয়া হয়। এমনকি যৌথ প্রযোজনার সিনেমার পোস্টারেও আমাদের শিল্পীদের মুখ ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুঁজতে হয়। হায়, আমরা কি এমন যৌথ প্রযোজনার ছবি চেয়েছিলাম! তাই অবশ্যই যৌথ প্রযোজনার সিনেমাগুলো নিয়ম-নীতি মেনে নির্মিত হচ্ছে কিনা, সেদিকে কঠোরভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তবে একটি কথা স্বীকার করতেই হবেÑ কলকাতার বাংলা সিনেমা গল্প, অভিনয়, নির্মাণ শৈলীর আধুনিকতায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। সিনেমার মানের দিক দিয়ে তারা বলিউডকে ছুঁয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রযোজক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলীদের এদিকে যেন খেয়ালই নেই! ইদানীং আমাদের সিনেমার গল্পে জোর করে হাসানোর চেষ্টা দেখে হাসি পায়। কোন কোন ক্ষেত্রে অতি-অভিনয় হাস্যকর হয়ে ওঠে। মনে হয়Ñ এমন সিনেমার পেছনে সময় নষ্ট করা বৃথা। অথচ কলকাতার সিনেমার গল্পে ভাড়ামো চোখে পড়ে না। গঠনমূলক গল্প, যুৎসই অভিনয়, হলিউড-বলিউডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ের নির্মাণশৈলী ও প্রযুক্তি, শিল্পী-কলাকুশলীদের একাগ্রতা, আন্তরিকতায় একেকটি সিনেমা দর্শকদের অন্তর স্পর্শ করে যায়। সিনেমাগুলো বার বার দেখেও যেন মন ভরে না। এ রকম ক’টি সিনেমা আমাদের দেশে এই সময়ে নির্মিত হচ্ছে? সম্প্রতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের তাগিদ দিয়েছেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রথিতযশা পরিচালক, অভিনেতা, লেখক আমজাদ হোসেনকে আন্তর্জাতিকমানের সিনেমা নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই পাকিস্তান আমলে শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানী আন্তর্জাতিকমানের সিনেমার কথা চিন্তা করেছেন। কিন্তু ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কতটি আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে? আন্তর্জাতিকমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো মেধাবী মানুষ আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে আছে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে যে মেরুকরণ চলছে, তাতে বহু দূরে এগোনোর পথ রুদ্ধ। আর দ্রুত এই বিভাজন বন্ধ করতে না পারলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। আমাদের প্রযোজক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলী, প্রদর্শকদের মাঝে কোন বিভেদ থাকলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প স্থবির হয়ে পড়বে। চলচ্চিত্র একটি রাষ্ট্রের আয়না। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প স্থবির হয়ে পড়লে পুরো রাষ্ট্রের ক্ষতি। তাই কোন অবস্থাতেই বিভাজন কাম্য নয়। এতে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষতি। বিভাজন থাকলে আমাদের চলচ্চিত্র কিভাবে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পৌঁছবে? একজন শিল্পী কি চান না তার অভিনীত সিনেমাটি বিশ্বের যেকোন প্রান্তের দর্শক দেখুক? একজন পরিচালক কি চান না বিশ্বের অন্য নির্মাতারা তার নির্মিত সিনেমা দেখে অবাক হবেন? অবশ্যই চান। তা চাইলে সিনেমা সংশ্লিষ্ট সবার ঐক্য প্রয়োজন। দর্শকরা ভাল সিনেমা দেখার প্রত্যাশায় থাকেন। যখন মুক্তিপ্রাপ্ত কোন সিনেমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তখন সব শ্রেণীর দর্শক ঠিকই সিনেমা হলে ভিড় করেন। তারা পাইরেসি কিংবা ইন্টারনেটে সিনেমা দেখার অপেক্ষায় থাকেন না। দর্শকদের চাহিদাÑ নতুন স্বাদের বিনোদনপূর্ণ গল্প, ভাল অভিনয়, চমকিত নির্মাণশৈলীর সিনেমা। দর্শক চাহিদা পূরণ হলে দর্শক কেন সিনেমা হলে যাবেন না? সিনেমা দর্শক কমে যাওয়ার পেছনে কেবল সিনেমা হলের পরিবেশের কথা বলা হয়। হ্যাঁ, হলের পরিবেশও পরিচ্ছন্ন এবং ভাল হতে হবে। সিনেমা হলগুলোকে টেকানোর ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে ঋণদান কিংবা প্রয়োজনীয় গঠনমূলক সহায়তার মাধ্যমে হলগুলো টেকানো গেলেও ভাল। কারণ, যে হারে সিনেমা হল কমে যাচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক! লেখক : চিকিৎসক [email protected]
×