ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপলকান্তি বড়‍ুয়া

নদীর গাছবন্ধু

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৯ আগস্ট ২০১৭

নদীর গাছবন্ধু

অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে নদী। এতক্ষণে একটু যা শান্তি। সেই সকাল থেকে একটানা কেঁদেই চলেছে নদী। বিষ্টিতে বন্ধুগাছের সঙ্গে খেলবে, কথা বলবে। গো ধরে বসে আছে। বাবা অফিসে যাওয়ার আগে সেই সকাল থেকেই ঝুম বিষ্টি। থামবার নাম নেই। শ্রাবণের ধারা অঝোরে ঝরছেই। অফিসে যাওয়ার সময় নদীকে আদর করেই তবে বাবা বেরোয়। -নদী কোথায়? নদী কই? বাবা খোঁজেন। মা খোঁজেন। দাদি খোঁজেন। না, নদী ঘরের কোথাও নেই। দাদা দেখেন, নদী বাসার সামনের বারান্দার সিঁড়িতে নেমে জবা ফুল গাছের ডাল পাতা ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। আঝোর বিষ্টি ধারার ঝটকা এসে নদীর চোখে মুখে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। নদী ইতোমধ্যে কাক ভেজা হয়ে গেছে। -ভিজে একেবারে একাকার হয়ে গেল যে মেয়েটা! -হায় হায় করে ওঠেন দাদি। মা দৌড়ে গিয়ে কোলে করে ঘরের ভেতর নিয়ে আসেন নদীকে। ভেজা মাথা হাত মুখ মুছে দেন। পরনের জামা কাপড় পাল্টে দেন তাড়াতাড়ি। সেই থেকেই কাঁদছে নদী। -না, আমি সিঁড়িতে খেলব। আমি বিষ্টিতে খেলব। আমার বন্ধুগাছের সঙ্গে খেলব-বলে বলে কাঁদছে তো কাঁদছেই। থামানোর কোন উপায় নেই। বাবা অফিসে যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতো অনেক আদর করেন। বললেন, -নদী মা, তোমার জন্যে তোমার প্রিয় চকোলেট, নুডুলস্ আনব অফিস থেকে আসার সময়। বিষ্টিতে ভিজতে নেই মা। সিঁড়িতে খেলতে গিয়ে ভিজলে যে তোমার আবার অসুখ করবে মা নদী। কে শোনে কার কথা। সেই একই সুরে কান্নার ধারা। -না, আমি খেলব। সিঁড়িতে খেলব। বন্ধুগাছের সঙ্গে খেলব। দাদি কোলে নিয়ে অনেক আদর করেন। কিছুতেই কিছু হয় না। সেই একই সুর নদীর। মা শোকেস থেকে ছোট মামার কিনে দেয়া নদীর প্রিয় লাল পুতুল হাতে দিলেন। না, তাতেও তার কান্নার গতি সেই একই ধারায় প্রবাহমান। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে, বাবার সঙ্গে নাস্তার টেবিলে অর্ধেক ডিম আর এক পিচ্ পাউরুটির খানিকটা ছিঁড়ে খেয়েছে নদী। সেই থেকে এ যাবৎ কিচ্ছু খায়নি সে। বাবা অফিসে চলে গেলেন। মা নদীকে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করেন। সব চেষ্টা বিফলে। না, কিচ্ছু খাবে না সে। সিঁড়িতে নেমে তার বন্ধুগাছের সঙ্গে খেলবেই, কথা বলবেই। নদীর বন্ধুগাছ। জবা ফুল গাছ। প্রতিদিন অনেক অনেক লাল ফুল ফোটে এ গাছে। জবা ফুল গাছটা বাসার সামনে ছোট্ট উঠানে সিঁড়ির পাশেই। ওপর থেকে দুই সিঁড়ি নিচে নেমে প্রতিদিন নদী স্কুল থেকে ফিরে, বিকেলে খেলার সময় ওর বন্ধুগাছের সঙ্গে কথা বলে। নানান কথা। অনেক কথা। ওর বন্ধুগাছ জবা ফুল গাছের ছোট্ট ডাল-শাখা ছুঁয়ে কথা বলে নদী। তার সবুজ পাতা, লাল ফুলকে আদর করতে করতে নানান কথা, আলাপ জমায়। তার বন্ধুগাছের লাল জবা ফুল কাউকে ছিঁড়তে দেয় না নদী। সে ভাবে, তার বন্ধুগাছের ফুল ছিঁড়লে বন্ধুগাছ তো ব্যথা পাবে। কান্না করবে। নদীর প্রথম শ্রেণীর ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো গতকাল। বাবা অফিসে যাওয়ার পর পরই প্রতিদিন নদীকে স্কুলে সঙ্গে করে নিয়ে যান মা। আজও ক্লাস ছিল। খুব সকাল থেকে একটানা অঝোরে বিষ্টি হচ্ছে বলে আজ স্কুলে নেননি মা নদীকে। দুপুর গড়াতে বাকি নেই আর। সেই থেকে এ যাবৎ বিছানায় কেঁদে কেঁদে এক পর্যায়ে নিজে থেকেই ঘুমিয়ে পড়ে নদী। সপ্তাহের শেষের দিন দুটা পর্যন্ত বাবার অফিস। বাবা বাসায় ফেরেন। মা বলেন- সকাল থেকে অবিরাম কেঁদে কেঁদে খানিক আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। খায়ওনি কিচ্ছু মেয়েটি। ওকে ঘুম থেকে ডেকো না। বিষ্টিরও যে আজ মাথা খারাপ হয়েছে। সেই সকাল থেকে একটানা ঝরছেই। এখনও থামার নামখানি পর্যন্ত নেই। বাবা বললেন- না ঠিক আছে। তা হলে ঘুমাক। বিষ্টিতে ভিজে অসুখ বাঁধানোর চেয়ে ঘুমানো অনেক ভাল। -আমি বিষ্টিতে ভিজব না বাবা। বিষ্টিতে সিঁড়িতে নেমে বন্ধুগাছের সঙ্গে কথা বলব না বাবা। নদী বিছানায় শোয়া থেকে উঠে বসে। বাবা-মার কথার ফাঁকে কখন যে নদী জেগে উঠেছে খেয়ালই করেননি। -এই তো আমার লক্ষ্মী মা নদী আমার- বলে বাবা অফিসের ব্যাগ হাত থেকে রেখে নদীকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নেন। -বাবা, আমার বন্ধুগাছ বলেছে, বিষ্টিতে ভিজে তার সঙ্গে কথা বললে আমার অসুখ করবে। আমার অসুখ করলে বন্ধুগাছের অনেক কষ্ট হবে। আমি বিষ্টিতে ভিজে বন্ধুগাছের সঙ্গে কথা বলার জন্যে আর কান্না করব না। -ওমা! তোমার বন্ধুগাছ তোমাকে এ কথা বলেছে? কখন বলল? -বাবা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করেন। মা, বাবার কথা শেষ হতে না হতেই বললেন, হুঁ বুঝেছি, নদী মা মনি। স্বপ্নে তোমার বন্ধুগাছ তোমাকে এ কথা বলেছে, তাই তো? নদী মুখে তেমন কিছু না বলে খানিকটা উদাস চেয়ে থেকে মাথা কাত করে সায় দে-হুঁ। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছে তা হলে মেয়ে-বলতে বলতে মা নদীর ডান গালে দু’আঙ্গুলের মিষ্টি চিমটি আদর রেখা এঁকে দেন। -মা, আমার খিদা পেয়ে তো! আমি খাব। বাবা বললেন, ও হো- আমার নদী মামনির খিদা পেয়েছে। চলো, চলো আমরা আজ বাবা-মেয়ে একসঙ্গে খাব, চলো চলো-বলতে বলতে বাবা মার সঙ্গে হেসে হেসে নদী ডাইনিংয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
×