ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেলসেতু উদ্বোধন

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৯ আগস্ট ২০১৭

সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেলসেতু উদ্বোধন

মশিউর রহমান খান ॥ উদ্বোধনের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল সেতু দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতু ও তিতাস নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় তিতাস রেল সেতু। নির্মাণকাজে বিলম্বের কারণে প্রকল্পের কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি ও বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক সহিংসতায় কাজ বন্ধ রাখাসহ নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির পর অবশেষে সেতু দুটি চালু করা হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের যে কোন দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেতু দুটির উদ্বোধন করবেন বলে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। উদ্বোধনের মাধ্যমে রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ঢাকা ও আখাউড়ার মধ্যে ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল করতে সহজ হবে ফলে এ রুটে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় কমে আসবে। একই সঙ্গে আরও যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চালানো যাবে। রেল সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে পুরো রেললাইনই ডুয়েল গেজ হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে। ডুয়েল গেজ সম্পূর্ণ হলে পার্শ্ববর্তী ভারত, মিয়ানমার ও চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করাও সম্ভব হবে। ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ট্রানজিট দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাংলাদেশের যে কোন স্থানে এবং পার্শ্ববর্তী দেশেও রেলপথে সরাসরি পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে। অপরদিকে দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতু ও তিতাস রেল সেতু চালু হলে ভৈরব ও আখাউড়া স্টেশনে কোন প্রকার ক্রসিং ছাড়াই সরাসরি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সময় এবং ট্রেনের সংখ্যাও বাড়বে। এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন করবে। বিদ্যমান প্রথম ভৈরব রেল সেতুর ৪০ মিটার ভাটিতে দ্বিতীয় সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু দুটির ছোট-খাটো সমস্যা ছাড়া সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। সেপ্টেম্বর মাসের যে কোন সময় এ সেতু দুটি উদ্বোধন করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পরই সেতু দুটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণ সহায়তা ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে এ দুটি সেতুর নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। ২০১০ সালের ৯ নবেম্বর একনেকের সভায় সরকার সেতু দুটি নির্মাণের জন্য প্রকল্প অনুমোদন দেয়। রেলওয়ে এ্যাপ্রোচসহ সেতু দুটি নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৯৫৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ সহায়তা (এলওসি) হিসেবে দেয়া হচ্ছে ৮২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ১৩৩ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বরে শুরু হওয়া মেঘনা নদীর ওপর দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ১২টি পিলার ও নয়টি স্প্যানবিশিষ্ট প্রায় ৯৮৪ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৭ মিটার প্রস্থের এ সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। অপরদিকে ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রী চলাচল ও পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করতে সরকার ডাবল লাইন তৈরি করছে। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ৩২০ কিলোমিটার রেলপথে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করতে অংশ চট্টগ্রাম-চিনকি-লাকসাম ও ঢাকা-টঙ্গী-ভৈরব অংশের ডাবল লাইন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া আখাউড়া-কুমিল্লা-লাকসাম পর্যন্ত বাকি ৭০ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইন করার কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এ সেতু দুটি উদ্বোধনের পর দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। এছাড়া ভৈরব ও আখাউড়া স্টেশনে ক্রসিং ছাড়াই ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে প্রায় ১ ঘণ্টা সময় কমে আসবে। একই সঙ্গে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো যাবে। জানা গেছে, দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতুটি ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু দুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সেতুটি উদ্বোধন হলে দেশের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ধ্বংস করে দিতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভৈরব রেল সেতুটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পরে পুনর্নির্মাণ শেষে ১৯৭৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেতুটির উদ্বোধন করেন। ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ও চাহিদার প্রেক্ষিতে পূর্বের ব্রিজটির পাশেই নতুন করে দ্বিতীয় ভৈরব সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার। ভারতীয় জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন-এফকনস জেবি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। দ্বিতীয় তিতাস সেতুর কাজও সম্পন্ন হয়েছে। এ ব্রিজটির পাশাপাশি ডাবল লাইনও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ প্রকল্পে মোট ৯টি সেতু ও প্রায় ৮ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ নম্বর ভৈরব ব্রিজের আগে ২৪, ২৫, ২৫-এ এবং পরে ২৭, ২৮, ২৯ নম্বর সেতুর সঙ্গে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এক নম্বর তিতাস রেল সেতুর সঙ্গে ১-এ সহ মোট ২টি সেতু ও ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার এ্যাপ্রোচ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। জানা গেছে, দ্বিতীয় ভৈরব সেতুর মতো ব্রিজ ভারতীয় রেলওয়েতেও নেই। এটি নির্মাণে প্রায় ৩০০ শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছেন। ভারতীয় দক্ষ শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ব্রিজটির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ওই সময় রাজনৈতিক সহিংসতা এবং রেল ও ট্রেনসহ সারাদেশের রেললাইনের ওপর ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের জন্য প্রায় সাত মাস কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় রেল কর্তৃপক্ষ। সেতুটির আশুগঞ্জ অংশে একটি প্ল্যাটফর্মও নির্মাণ করা হয়েছে। অপরদিকে, এর আগে মেঘনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল সেতু নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। খোদ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগই (আইএমইডি) এ অভিযোগ তুলে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে আইএমইডি। বিষয়টি অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আগামী ২ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। আইএমইডির মতে, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে দুর্বল করে তৈরি করা হচ্ছে এ সেতু। ঢালাই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পলি মিশ্রিত বালি আর নিম্নমানের পাতলা ও ভঙ্গুর পাথর। ফলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সেতুর ঢালাই কাজ। এছাড়া করা হয় নানা অভিযোগ। এরই প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে সেতুটি যথাযথভাবে নির্মাণে বিশেষ পদক্ষেপ নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল সেতু দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস রেল সেতু দুটি চালু হলে দেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে তথা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর ঢাকার রেল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিণত হবে। বর্তমানে দুটি সেতুই নির্মাণ শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। সময় সাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বর মাসের যে কোন সেতু দুটি উদ্বোধন করবেন। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চাহিদার প্রেক্ষিত্রে সেতু দুটি ভারত সরকারের এলওসি ফান্ডের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুগুলো উদ্বোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় পণ্য পরিবহনে সেতু দুটি শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সেতুগুলো উদ্বোধন হলে এই রুটে বর্তমানের চেয়ে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যাবে পাশাপাশি যাত্রী সুবিধাও আগের চেয়ে অনেক বাড়বে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি যাত্রী ও পণ্য চলাচল সহজ হবে।
×