ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রম বিক্রির হাট

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৯ আগস্ট ২০১৭

শ্রম বিক্রির হাট

বরগুনার তালতলী উপজেলা শহরের ভূমি অফিসের সামনের মাঠে প্রতিদিন সকাল ৭টায় ছাতা মাথায় পোঁটলা বাঁধা মানুষের ভিড় জমে। তারা বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে আসা অভাবী শ্রমজীবী মানুষ। বছরের শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন চাষাবাদের উপযুক্ত সময়। এ সময় শ্রমজীবী মানুষের চাহিদা বেশি। প্রতিদিন তালতলীতে শ্রম বিক্রির হাট বসে। তবে রবিবার সাপ্তাহিক বাজার হওয়ায় শ্রম বিক্রির হাট বেশি জমজমাট থাকে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে শুরু করে ১০টা পর্যন্ত দর কষাকষি করে শ্রমজীবীর শ্রম বিক্রি হয় কিন্তু রবিবার চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তালতলীর এ শ্রম বাজারটি ৫০ বছর ধরে চলে আসছে। সহস্রাধিক শ্রমজীবী মানুষ হাটে আসে বিক্রি হতে এবং উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ কৃষি কাজের জন্য তাদের কিনে নিচ্ছেন। চলতে থাকে অন্যান্য পণ্যের মতো দর কষাকষি। সকাল বেলা চাহিদা বেশি থাকে। শ্রমজীবীরা দামও বেশি পায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে চাহিদা কমে যায় এবং দামও কমে। তবে কোন শ্রমজীবী অবিক্রীত থাকে না। স্থানীয়ভাবে শ্রমজীবীদের বলে দিনমজুর, আবার কেউ বলে বদলা। ৭০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে দলে দলে ছুটে আসেন এ অঞ্চলে। এ মানুষগুলোর অধিকাংশই আশ্রয়হীন, ছিন্নমূল, হতদরিদ্র। ক্রেতাদের কাছে তারা কেউ কেউ এক সপ্তাহ আবার কেউ কেউ এক মাস আমনের ক্ষেত রোপণের জন্য বিক্রি হয়। আমনের ক্ষেত চাষাবাদের সময় এ অঞ্চলে দিনমজুর অথবা কৃষি কাজের মানুষের বড়ই অভাব থাকে। তাই বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা অভাব-অনটনে থাকা মানুষগুলোর এই অঞ্চলে এলেই তাদের কাজের অভাব হয় না। কারণ এই অঞ্চলের বেশিরভাগই মানুষ কৃষিনির্ভর। সে কারণে এসব শ্রমজীবী শ্রম বিক্রি করতে বার বার এখানে ছুটে আসেন। ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় এ শ্রম বিক্রি হয়। তবে শ্রম কেনা মালিকের পছন্দের ওপর নির্ভর করে শ্রমের মূল্য। বৃদ্ধের চেয়ে জোয়ানদের চাহিদা বেশি। তবে অনেকে শরীরের গঠন দেখেও ক্রয় করে। এ যেন পণ্য বিক্রির হাট। তালতলীর শ্রম বিক্রির হাট শ্রমজীবীদের অতি পরিচিত হওয়ায় বরগুনার ছোট গৌরিচন্না, ফুলঝুড়ি, শর্শিমুড়ি, আয়লা, চান্দখালী, বেতাগী, বকুলতলী, উত্তর বকুলতলী, ঝালকাঠির আমুয়া ও নলচিঠিসহ বিভিন্ন জেলার শ্রমজীবীরা আসে। এ শ্রমজীবী মানুষগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে স্বভাবে রসিক ও বয়াতি প্রকৃতির। সারাদিন কাজ শেষে মহাজনের বাড়িতে স্বাচ্ছন্দে বসে কিচ্ছা ও গানের আসর নিয়ে। মনের সুখে গান গেয়ে ও কিচ্ছা বলে অন্যকে আনন্দ দেয় এবং নিজেও আনন্দিত হয়। কাজের সন্ধানে আসা বেতাগীর বকুলতলী গ্রামের সেন্টু হাওলাদার,ও সেন্টু মিয়া দু’জনে মিতা (বন্ধু)। দু’মিতা বলেন এ সময় গ্রামের বাড়িতে কোন কাজকর্ম নেই। তাই এ অঞ্চলে কাজের সন্ধানে ছুটে আসেছি। এলাকা একদিন কাজ করলে দুদিন বসে খেতে হয়। এতে পরিবার পরিজন নিয়ে খুব কষ্ট হয়। তারা আরও বলেন এ অঞ্চলে কাজের চাপ বেশি, তাই বলদার (শ্রমিকের) চাহিদা বেশি। দৈনিক জনপ্রতি ৩৫০ টাকা হিসেবে সাত দিনের কাজের জন্য এক মহাজনের কাছে চুক্তিতে কাজে এসেছি। উত্তর বকুলতলী গ্রামের জাকির রয়াতি বলেন ‘মোরা গরিব মানুষ খাইট্টা খাই, দ্যাশে কাম নাই হেইলইগ্যা বদলা দেতে আইছি, এ এলাকায় বদলার দাম বেশি, জিগায়ও বেশি। একমাস থাইক্কা যে টাহা কামাই হরমু হেইয়্যা দিয়া সোংসার চালামু।’ হোসাইন আলী কাজী আমতলী, বরগুনা, থেকে
×