ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিল-বাঁওড়

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৯ আগস্ট ২০১৭

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিল-বাঁওড়

নদ-নদী আর বিল বাঁওড়ে পরিপূর্ণ মাদরীপুর অঞ্চল। উজান-ভাটির দোটানায় দেশের দক্ষিণের মধ্যভাগের ভাটির জনপদ এটি। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বেশ ক’টি নদ-নদী বহমান এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। আবার প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে বহু বিল-বাঁওড়। এ সব নদ-নদী বিল বাঁওড় এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কখনও আশীর্বাদ কখনও অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। তবে অভিশাপের চেয়ে আশীর্বাদের পাল্লাটাই ভারি। এখানকার মানুষ প্রাচীনকাল থেকে নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন। এ সব মুক্ত জলাশয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। তাই নদ-নদী বিল-বাঁওড় এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, ময়নাকাঁটা, কুমার, নিম্নকুমার, মধুমতি, পালরদীর মতো নদ-নদীগুলো এ অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে। এর মধ্যে কোন কোনটি জেলা মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবহমান। রয়েছে বাঘিয়ার বিল, পিতাম্বর বিল, বিল পদ্মা, গৈদির বিল, পাঁচখোলা বাঁওড়, হাউদী বাওড়, আড়িয়ালখাঁ বাঁওড়, খাতিয়াল বিল, কদমবাড়ি বিল, লখন্ডার বিল, আমগ্রাম বিল, শশীকর বিল, লক্ষ্মীগঞ্জ বাঁওড়, চলবল বিল, সস্তাল বাঁওড়ের মতো বড় বড় জলাশয়। এক সময় নানা জীববৈচিত্র্যে ভরা ছিল এ সব বিল-বাঁওড়। শাপলা, শালুক, শোলা, ধৈঞ্চা, কলমি, কচুরিপানা, মালঞ্চ, হেলেঞ্চাসহ বিভিন্ন আকৃতির কচু ও নানা জলজ উদ্ভিত। ছিল কৈ, শিং, মাগুর, চিতল, শোল, গজার, খইলসা, পুটিসহ নানা প্রজাতির প্রচুর মাছ। এ সব সম্পদ আহরণ করে এলাকার শত-সহস্র দরিদ্র পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। এছাড়াও চিল, শালিক, বাবুই, টুনটুনি, বক, মাছরাঙা, বুনোহাঁস, পানকৌড়ি, ডাহুকসহ নানা জাতের অতিথি পাখির আনাগোনায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর থাকত এ সকল বিল-বাঁওড়। শীতের মৌসুমে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার কি.মি. পাড়ি দিয়ে এ অঞ্চলে আসত রং বেরঙের অতিথি পাখি। এ সব অতিথি পাখির কলকাকলীতে বিল-বাঁওড়ের বুক মুখরিত থাকত। গোধূলি সন্ধ্যায় আবির মাখা আকাশে হাজারো পাখির উড়াউড়ির দৃশ্য ছিল মনোমুগ্ধকর। রাতে এ অঞ্চলের বন-বাদাড়ে নানা পাখির কিচির মিচির এ অঞ্চলের পরিবেশ আরও মুখরিত হয়ে উঠত। শুধুই পাখপাখালী নয় দিনভর মানুষের কর্ম ব্যস্ততায় মুখর থাকত বিল-বাঁওড়গুলো। প্রাণচাঞ্চল্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। বিল অঞ্চলের সহস্রাধিক দরিদ্র পরিবারের মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে নেমে পড়তো বিলের পানিতে। বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতিভাবে জন্ম নেয়া শাপলা-শালুক-শামুক কুড়িয়ে নেওয়ার ধুম পড়ে যেত। বাঘিয়ার বিল, মহিষমারীর বিল, কদমবাড়ির বিল, লখন্ডার বিলে। এখন থেকে প্রতিদিন খেটে খাওয়া মানুষ প্রচুর শাপলা-শালুক তুলে, মাছ ও শামুক ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখানকার শাপলা মাদারীপুর, ফরিদপুর, বাগেরহাট, নড়াইল, খুলনা, বরিশাল এমন কি ঢাকার বিভিন্ন হাট বাজারেও পাইকাররা বিক্রির জন্য নিয়ে যেত। পাশাপাশি খ্যাপলা জাল, বেড়জাল ও মাছ ধরার নানা ফাঁদ পেতে মাছ শিকার করতো দরীদ্র জনগোষ্ঠী। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হতো কে বেশি শাপলা-শালুক তুলবে, কার ডিঙ্গি নৌকা কত তাড়াতাড়ি ভরে যাবে, কে কত মাছ ধরবে, কে কার আগে বাজারে যাবে এ সব বিক্রি করতে। চলতো বাস্তবতার সঙ্গে জীবনে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা। পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও বড়দের সঙ্গে শাপলা-শালুক তোলার কাজে বিলে নেমে সহায়তা করত। সেদিনের সে অপরূপ দৃশ্য এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না। বছরের আট মাসই জেলার বিল-বাঁওড়গুলো জলাবদ্ধতার কারণে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা থাকত। এ সব বিল-বাঁওড়কে ঘিরে মানুষের স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু ক্রমাগত প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ, উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যায় উজান থেকে বয়ে আসা পলিমাটির স্তর পড়ে নদ-নদীর সঙ্গে বিল-বাঁওড়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় পাল্টে যেতে থাকে জলাধারগুলোর প্রাকৃতিক চেহারা। তাই বিল-বাঁওড়ে শাপলা-শালুক-শামুক কুড়ানো আর মাছ ধরার প্রতিযোগিতা তেমন একটা নেই। তবে এখনও বর্ষা মৌসুমে বিল-বাঁওড়ের বুক জুড়ে প্রচুর শাপলা দেখা যায়। যা বিক্রি করে এই অঞ্চলের বহু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। বর্ষা মৌসুমে উজানের পানিতে ডুবে যায় বিল-বাঁওড়। বন্যা দেখা দিলে এ জলাশয়গুলোর পানি পাড় উপচে তলিয়ে যায় ক্ষেত-খামার। চারদিকে থৈ থৈ করে পানি। ভরা বর্ষায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী লোক প্রযুক্তির নানা ফাঁদ বইচন্যা, পলো, ঘুনি, চাই, দোয়াইর, খ্যাপলা জাল, বুচনা জাল, বেড় জাল, বাইন, টেঁটা, জ্যুতি, কোচ, বরশি নিয়ে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় বিল-বাঁওড়ে ভেসে বেড়ায়। কয়েক শ’ বছরের পুরনো বাঘিয়ার বিলসহ বড় বড় বিল বছরের আট মাস জলাবদ্ধ থাকে। ফলে এই বিলে শাপলা-শালুকের পাশাপাশি নানাজাতের দেশীয় মাছ আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এ বিলে বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে শাপলা জন্মায়। এই অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা বিল থেকে শাপলা তুলে আনে। তাদের কাছ থেকে পাইকাররা অল্পদামে শাপলা কিনে নেয়। এরপর পাইকাররা রাজৈর, টেকেরহাট বন্দর এবং গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলা শহরের পাইকাররা কিনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে খুচরা কাঁচামাল ব্যবসায়ীরা শহরসহ আশপাশের বাজারগুলোতে বিক্রি করে। আবার অনেক পরিবার আছে যারা বিল থেকে শাপলা তুলে বেশি লাভের আশায় নিজেরাই স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করে। ১০ থেকে ১৫টা শাপলা এক সঙ্গে বেঁধে ৫টাকা আর শহরগুলোতে ১০ টাকা করে বিক্রি করতে দেখা যায়। জেলার ছোট-বড় বিল-বাঁওড়ের আরেক অর্থকরী জলজ সম্পদ শামুক। এ সব বিল-বাঁওড়ে বিপুল পরিমাণে শামুক পাওয়া যায়। এক শ্রেণীর মানুষ যারা শুধু শামুক আহরণ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। তারা বিল-বাঁওড় থেকে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা, কলা গাছের ভেলা ও ট্রলার নিয়ে শামুক আহরণ করে চটের বস্তায় ভরে খুলনা, বাগেরহাটসহ অন্যান্য অঞ্চলের চিংড়ি ঘেড়ে বিক্রি করে। চিংড়ি ঘেড়ের মালিকরা ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার জন্য শামুক একটি মূল্যবান সম্পদ। শামুক বিক্রয়লব্ধ অর্থে এ সব মানুষের ৪/৫ মাসের খাদ্যের সংস্থান হয়। সুতরাং শাপলা-শালুক, মাছ, জলজ সম্পদ ও শামুক যাদের খাদ্যের যোগান দেয়-তাদের কাছে বিল-বাঁওড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। নদ-নদী, বিল বাঁওড় প্রকৃতির দান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্ত-অসীম। কিন্তু নানা কারণে দিন দিন জেলার নদ-নদী, বিল-বাঁওড় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বেশ কটি বিল-বাঁওড় ইতোমধ্যে বালুচরে পরিণত হয়ে হারিয়ে ফেলেছে তার নিজস্ব সৌন্দর্য। চোখের সামনে ধূসর হয়ে গেছে কোন কোনটি। আর হাতে গোণা বড় বড় বিল-বাঁওড়গুলো অস্তিত্ব সঙ্কটে কোন রকম টিকে আছে। এ সব বিল-বাঁওড়ের সেই জৌলুস আজ আর নেই। হয়ত এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন চোখের সামনেই হারিয়ে যাবে জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গর্বিত আধার বিল-বাঁওড়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস। সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×