ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রায় রিভিউর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার ॥ আইনমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৯ আগস্ট ২০১৭

রায় রিভিউর প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার ॥ আইনমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীমকোর্টে বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের জন্য সরকার প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তিনি বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের সার্টিফাইড কপির জন্য দরখাস্ত করা হয়েছে। রায়টি আরও পরীক্ষা করা হচ্ছে। আরও পড়ে দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ রিভিউয়ের জন্য সরকার তৈরি হচ্ছে। শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সরকারী শিশুদের পরিবারের অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, রায়ের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় এবং আপত্তিকর যে কথাগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখানো স্বাভাবিক। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ উগ্র কোন প্রতিক্রিয়া না দেখায় বা প্রতিক্রিয়ার কোন ভাষায় আদালত অবমাননা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো অন্যায় নয়। আনিসুল হক আরও বলেন, সরকার রায়ের সঙ্গে হয় তো একমত পোষণ করে না, কিন্তু রায়কে শ্রদ্ধা করে। এখন অনেকেই বলছেন তদন্তের ত্রুটির কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত রাঘব বোয়ালরা ছুটে গেছে উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা কিন্তু ১৯৭৫ সালে বা আশির দশকে কিংবা নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে শুরু হয় নাই। শুরু হয়েছে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে। তিনি বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তারাই এই হত্যাকা-ে জড়িতদের এভিডেন্স লুকানোর এবং সরানোর কাজটা করেছেন। সুতরাং ২১ বছর পর যে তদন্ত হয়েছে তা বাস্তবভিত্তিক ছিল। খাবার বিতরণের সময় আইন সচিব আবু সালেহ্ শেখ মোঃ জহিরুল হক, নিবন্ধন পরিদফতরের মহাপরিদর্শক খান মোঃ আব্দুল মান্নান, আইন ও বিচার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহাসহ আইন মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করেন। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল, ‘বলতে দ্বিধা নেই, ষোড়শ সংশোধনী একটি কালারেবল লেজিসলেশন (কোন কাজ সংবিধানের মধ্যে থেকে করার সুযোগ না থাকলে আইনসভা যখন ছদ্ম আবরণে ভিন্ন প্রয়োজনের যুক্তি দেখিয়ে একটি আইন তৈরি করে), যা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘন। এটা সংবিধানের দুটি মূল কাঠামো ৯৪(৪) ও ১৪৭(২) অনুচ্ছেদেরও লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৭(বি) অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে রুল যথাযথ (এ্যাবসলিউট) ঘোষণা করা হলো। ষোড়শ সংশোধনী আইন ২০১৪ কালারেবল, এটি বাতিল এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলো।’ তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৩ জুলাই সরকারের আপীল খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্ট। এর ফলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধই থেকে যায়। গত ১ আগস্ট প্রকাশিত আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, মামলার ‘ফ্যাক্ট অব ইস্যুর’ সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ‘অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা’ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন। তিনি বলেন ‘প্রধান বিচারপতি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। আমি মনে করি, ওই সকল রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালত কর্তৃক বিচার্য বিষয় হতে পারে না। আমরা তার ওই বক্তব্যে দুঃখিত। আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি (প্রধান বিচারপতি) রায়ের আরেক জায়গায় বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন একক ব্যক্তির কারণে হয় নাই। আমি তার এই বক্তব্যে মর্মাহত। এরপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন আইনমন্ত্রী। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আজ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই বাস্তব সত্যকে পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, সেটাই আমার জন্য অনেক কষ্টের এবং লজ্জার। তাই আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমাদের নিরীক্ষায় প্রধান বিচারপতির রায়ে যে সব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য আছে, সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগও আমরা নেব। আইনমন্ত্রীর আগে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, অনারেবল চীফ জাস্টিস যদি বলেন, পার্লামেন্ট ইজ ইমম্যাচিউরড বা সংসদ সদস্যরা অপরিপক্ক, তাহলে তো আমাকে বলতে হয়, অভিয়াসলি লজিক্যালি চলে আসে, সুপ্রীমকোর্টের জজ সাহেবরাও তাহলে ইমম্যাচিউর।
×