ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাপক ক্ষতির মুখে কৃষক

এবারের বন্যায় ৫ লাখ হেক্টরের বেশি আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১৯ আগস্ট ২০১৭

এবারের বন্যায় ৫ লাখ হেক্টরের বেশি আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ টানা তৃতীয় দফার বন্যায় এবার নতুন করে ৩৪ জেলায় সাড়ে ৫ লাখ হেক্টরের বেশি ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। প্রায় ৫ লাখ হেক্টরের বেশি আমনের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষক। কোথাও কোথাও ধানের গোছাগুলো পোক্ত হওয়ায় পানি সরে গিয়ে তা জেগে উঠতে শুরু করলেও মধ্যাঞ্চলের আবাদি জমিগুলো নতুন করে তলিয়ে যাচ্ছে। বন্যায় নতুন করে তলিয়ে যাওয়া আমনের বীজতলার পরিমাণ ৬ হাজার ৬২৬ হেক্টর। এছাড়াও ১১ হাজার ২৫৪ হেক্টর শাকসবজি, ৭ হাজার ৩৯৬ হেক্টর বোনা আমন ও ১৬ হাজার ৭৯৯ হেক্টর আউশ ক্ষেত সম্পূর্ণ বা আংশিক তলিয়ে গেছে। এতে দেশে বড় ধরনের খাদ্য সঙ্কটের দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তবে এ আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছে সরকারী সংস্থাগুলো। তারা বলছেন, পানি কমে গেলে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। চলতি আমন মৌসুমের জন্য তৈরি আছে ভাসমান বীজতলাও। পানি সরে যাওয়ার পর জমিতে আবারও নতুন করে আমন আবাদের চেষ্টা চালানো হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ তাজুল ইসলাম পাটোয়ারি জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত যে হিসাবটি এসেছে তা পানিতে নিমজ্জিত ফসলের পরিমাণ। পানি সরে যাওয়ার পর আসলে বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হয়েছে। ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চল থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে। তবে নতুন করে আবার মধ্যাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এতে এখনই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে করণীয় প্রসঙ্গে পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে আক্রান্ত জেলাগুলো হচ্ছে-রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, বি’বাড়ীয়া, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ফেনী, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজবাড়ী, চাঁদপুর ও ফরিদপুর। এরমধ্যে রাজশাহী জেলায় ৯৫ হাজার ৩৪৭ হেক্টর জমির মধ্যে ৬ হাজার ১০৬ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। জেলাটিতে ৬৯ হাজার ২২৭ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ১ হাজার ১০৯ হেক্টর। আর তলিয়ে যাওয়া শাকসবজির জমির পরিমাণ ১৩৭ হেক্টর। অন্যদিকে জেলাটিতে ৪ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমির আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রংপুর জেলায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৪১৬ হেক্টর জমির মধ্যে ৩৮ হাজার ৮১৫ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ বা আংশিক তলিয়ে গেছে। আর জেলাটিতে আমনের তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৭০০ হেক্টর। ঠাকুরগাঁওয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমির মধ্যে ৩৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়েছে। জেলাটিতে তলিয়ে যাওয়া আমন ধানের পরিমাণ ৩৭ হাজার হেক্টর। লালমনিরহাটে প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর দ-ায়মান ফসলি জমির মধ্যে ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। আর তলিয়ে যাওয়া আমনের পরিমাণ ৩১ হাজার হেক্টরেরও বেশি। কুড়িগ্রামে তলিয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার হেক্টর রোপা আমনের ক্ষেত। এদিকে টাঙ্গাইলে প্রায় ৭২ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১০ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৫ হাজার হেক্টরের ওপরে। তবে সম্প্রতি যমুনার বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় জেলাটিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। একই অবস্থা সিরাজগঞ্জেও। জেলাটিতে ৭৬ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি তলিয়ে গেলেও নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। জেলাটিতে এখন পর্যন্ত রোপা আমনের তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৮৪২ হেক্টর। অন্যদিকে জামালপুরে ৮৪ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ৪৩ হাজার হেক্টর জমিই তলিয়ে গেছে। আর ময়মনসিংহে ১ লাখ ৬২ হাজার জমির মধ্যে তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ ১৩ হাজার হেক্টরের বেশি। কিশোরগঞ্জে ৬৭ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টরের বেশি জমি তলিয়েছে। জেলাটিতে তলিয়েছে ২ হাজার ১৫২ হেক্টর আমন আবাদি জমি। কৃষক পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আমনের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকজন কৃষক জানান, পানি সরে গিয়ে আমনের ক্ষেত জেগে উঠতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কেথাও এখনও আমনের ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার চন্দপুর গ্রামের কৃষক মোঃ শহীদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, তার প্রায় ৯০ শতাংশ জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেলেও বর্তমানে পানি সরে গেছে। ধানের গোছাগুলো মোটামুটি পোক্ত হওয়ায় এখন তা জেগে উঠবে বলে তার প্রত্যাশা। তিনি বলছেন, পানি সরে যাওয়ার পর ধানের গোছাগুলো জেগে ওঠায় তেমন একটা ক্ষতি হবে না। এদিকে কৃষি তথ্য সার্ভিসের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে বন্যায় যেসব জেলার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা হবে, সেসব জমিতে পুনরায় চারা রোপণের চেষ্টা চলানো হবে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বীজতলা প্রস্তুত করা হয়েছে। মজুদ রাখা হয়েছে আমন ধানের চারাও। একই সঙ্গে আরও বীজতলা তৈরির কাজ চলছে। এরমধ্যে সরকারীভাবে প্রথমেই ৭২০টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। যেসব প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র কৃষকের আমনের চারার প্রয়োজন হবে তাদের মধ্যে এসব চারা বিতরণ করা হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারী গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার টন এবং গম রয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার টন। এছাড়া বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় আছে ৮৩ হাজার টন খাদ্যশস্য। দেশে খাদ্য সঙ্কটের শঙ্কা রয়েছে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারী উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বন্যায় যেসব এলাকায় ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে সেসব এলাকার বাসিন্দারা কিন্তু তার ঘরে মজুদ থাকা খাদ্যশস্যও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। কেউ কেউ হয়তো কিছু কিছু নিয়ে গেছে। তবে সবটা নয়। একই সময়ে মানুষের হাতে চালের মজুদও তেমন নেই। সরকারী পর্যায়েও নেই। তারা যে সাহায্যটা করছে তা অতি সামান্য। ২০ লাখ টন চাল আমদানির কথা বলা হলেও কবে আনা হবে, কবে টেন্ডার হবে; এখন পর্যন্ত তা কিন্তু আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, একই সময়ে আন্তর্জাতিক চালের বাজারও খারাপের দিকে। চীন ও শ্রীলঙ্কায় চালের উৎপাদন খুবই কম হয়েছে। তারাও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে। আমাদের তো তাদের সমান সামর্থ্য নেই। তিনি আরও বলেন, সরকার বলছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে চাল আমদানি করবে। কিন্তু কম্বোডিয়ায় যে চাল হয়, আর তা থেকে যে ভাত হয়; তা কিন্তু আঠালো। আমরা সে রকম ভাত খাই না। সাহায্যে যদি এ চাল বিতরণ করা হয় তাহলে হয়তো মানুষ না পেরে খাবে। এটাও কিন্তু সরকার বিবেচনায় নেয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মজুদ তো পর্যাপ্ত নয়। খাদ্য সঙ্কট শুরু হলেও সেই সঙ্কট মোকাবেলায় যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে, তা সরকারের হাতে নেই।
×