ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

এক জঘন্য নির্মমতার শিকার ॥ আইভি রহমান

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১৮ আগস্ট ২০১৭

এক জঘন্য নির্মমতার শিকার ॥ আইভি রহমান

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের পথ ধরে নতুন করে ঘটানো হয়েছিল এই মাসের আরও একটি জঘন্য নৃশংসতা। উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নারকীয়ভাবে হত্যাকা-ের ওই সময়টিতে তাঁর দুই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে ছিলেন। ফলে সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে যান। যেসব বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারী এই ন্যক্কারজনক অপকর্মের অংশীদার ছিল তারাই আবার লক্ষ্য নিশানা করে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ বংশধরের ওপর। অত্যন্ত সুপরিকল্পিত কর্মপ্রক্রিয়ায় তৎকালীন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এমন কলঙ্কিত হামলাটি পরিচালনা করে। এবারও ভাগ্যক্রমে এবং আয়ু থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রী বেঁচে যান। তবে তাঁর শ্রবণশক্তিতে গুরুতর জখম হওয়ার কারণে সে দায়ভাগ এখনও তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলার আঘাতে ২৪ জন নেতাকর্মী তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন। আহতের সংখ্যা প্রায় ৪শ’। স্পিøলিন্টারের আঘাতে জর্জরিত তৎকালীন মেয়র হানিফ অনেকদিন চিকিৎসার পর মারা যান। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী আইভি রহমান যেভাবে গ্রেনেড হামলার সহিংসতার শিকার হন তা যেমন বেদনাদায়ক একইভাবে সভ্যতা বির্বজিত এক লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর ঘটনা। যা আজও তাঁর স্বজন আর শুভাকাক্সক্ষীদের শিহরিত করে, মর্মান্তিক কষ্টে কাঁপিয়ে দেয়। শোকে মুহ্যমান আইভি রহমানের সন্তানরা আজও হৃদয়বিদারক আর মর্মস্পর্শী অনুভবে সে দিনকে স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ৯ আগস্ট বুধবার বাংলাদেশ মহিলা সমিতি আয়োজিত আইভি রহমান মিলনায়তনে জননন্দিত এই নেত্রীর স্মরণে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইভি রহমানের একমাত্র পুত্র সংসদ সদস্য জানমুল হাসান এমপি। কন্যা তানিয়া বাখতও সভায় বক্তব্য রাখেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা। আইভির অত্যন্ত প্রিয় সন্তানরা মায়ের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আজও মানতে পারেননি। বিনা অপরাধে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে কলঙ্কিত রক্তাক্ত অধ্যায়ের অবতারণা করা হয় তার কি কোন জবাব অপরাধীদের কাছে আছে? সুদীর্ঘ ১৩টা বছর পার হলেও এই নৃশংস ঘটনার অপরাধীরা আজও শাস্তির মুখোমুখি হয়নি। বিচারিক প্রক্রিয়া তার নিজস্ব নিয়মে দীর্ঘসূত্রতার আবর্তে আটকে আছে। এই নিয়েও সভায় নিন্দা আর ক্ষোভ জানানো হয়। এই স্মরণ সভার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল প্রয়াত আইভি রহমানের বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এবং ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আইভি রহমান কর্মজীবী নারী প্রশিক্ষণ বিভাগের কার্যক্রম উপস্থাপন করা। শুধু তাই নয় এসব প্রশিক্ষিত নারী উদ্যোক্তাকে বিশেষ সম্মাননা সূচক সনদপত্রও বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে কন্যা তানিয়া বাখত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে স্বাগত বক্তব্য দিয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের অভিনন্দন জানান। মায়ের স্মৃতি স্মরণ করে অশ্রুসজল নয়নে তানিয়া উপস্থিত দর্শকদের শোকাভিভূত করে দেন। আইভি শুধু একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদই ছিলেন না একজন বড় মাপের মানুষও যা তাঁকে চিরদিন কাছের মানুষদের কাছে বাঁচিয়ে রাখবে। সময়ানুবর্তিতা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে সময় মতো উপস্থিত থেকে যে কোন অনুষ্ঠানকে দীর্ঘসূত্রতার জালে আবদ্ধ হতে দিতেন না। সংগঠন প্রদত্ত ক্ষমতা আর কর্তৃত্বকে কখনও অপব্যবহার করতে কেউ দেখেনি। নিজের অধিকারের সীমাটা এত বেশি বুঝতেন যে, অনেক সময় প্রাপ্যটুকু ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করতেন না। নাজমুল হাসান দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মায়ের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকোর মহাপরিচালক। অথচ মায়ের মৃত্যুশয্যায় একটা ওষুধও তিনি মায়ের জন্য ব্যবহার করতে পারেননি। এই কষ্ট তাঁকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হবে। অথচ কত মানুষের দুঃসময়ে মায়ের আদেশে কত ওষুধ তাকে সরবরাহ করতে হয়েছিল সে স্মৃতিও তাঁকে তাড়িত করে। নাজমুল হাসান থেকে এমন পরামর্শও আসে যাদের বাবা-মা জীবিত আছেন তারা যেন এখন থেকেই তাদের সেবা শুশ্রƒষার ভার নেন। কারণ এমন সুবর্ণ সময় সবার ভাগ্যে থাকে না। সংগঠনের সভানেত্রী সিতারা আহসানউল্লাহ তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন আইভি রহমানের মতো দক্ষ আর অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের শূন্যস্থান পূরণ কোন সহজ ব্যাপার নয়। তাঁর মানবিক বোধ, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা সব মিলিয়ে তিনি শুধু একজন নেতার আসনেই বসেন না সঙ্গে সঙ্গে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেন। তাঁর আদর্শিক চেতনা আর মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়েই ২০০৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ‘আইভি রহমান কর্মজীবী নারী প্রশিক্ষণ বিভাগ’ চালু করে আইভির পুণ্য স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করেই। সেই থেকে আজ অবধি এই প্রকল্পটি তার নানামাত্রিক কর্মপ্রক্রিয়া নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পটি নিম্নলিখিত কার্যক্রমে তাঁর নানাবিধ প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেÑ ক. বৈশাখী ও ফাল্গুনী মাদার্স ক্লাব সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পরিচালিত স্কুলে আগত ও অপেক্ষমাণ মায়েদের জন্য ‘বৈশাখী ও ‘ফাল্গুনী’ নামে দুটি ক্লাব করা হয়। এসব মাকে বিভিন্ন রকম হস্তচালিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। যেমনÑ মেশিন এ্যামব্রয়ডারি, সেলাই, ব্লক বাটিক, কাগজের ঠোঙা তৈরি, কেক, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি। বয়স্ক শিক্ষাÑ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মায়েরা যাতে এই ‘বয়স্ক শিক্ষার’ আওতায় কিছুটা হলেও শিক্ষা লাভ করতে পারে। অভিজ্ঞ শিক্ষিকা দ্বারা পিছিয়ে পড়া মায়েদের অক্ষরজ্ঞান দিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার এই প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস। এর পাশাপাশি আইনী সহায়তা, পরিবেশ সচেতনতাসহ বিভিন্ন হাতের কাজেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের কাটিং/সেলাইয়ের ওপর ফ্রি (৩ মাস) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গত ১ বছরে ১৯ জন প্রশিক্ষণার্থীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সবশেষে উত্তীর্ণদের সনদপত্র প্রদান করা হয়। হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ এখানে বাঁশ, বেত, পাট, চট ও পুঁতির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর ওপর কাজ শেখানো হয়। প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কর্মশালারও আয়োজন করা হয়। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সনদপত্রও প্রদান করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা সচেতনতাও এই প্রকল্পের অন্যতম কার্যক্রম। একজন অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে এই স্বাস্থ্যসেবা মূলক কর্মপ্রক্রিয়া চালানো হয়ে থাকে। নিবন্ধিত রোগীদের নিয়ে এই চিকিৎসা সেবার কাজ চলতে থাকে। সুস্বাস্থ্যের জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায়। তাৎক্ষণিক সেবা প্রদানই এর প্রধান লক্ষ্য। পুরো প্রকল্পটি সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং দুস্থ শিশু ও নারীদের জন্যই পরিচালিত। এটি একটি মহৎ এবং বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা যা আইভি রহমানের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রকল্পের পরিসর বৃদ্ধি করে নারী ও শিশুদের স্বাবলম্বী করার প্রক্রিয়া যেন অব্যাহত করা যায় সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
×