ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

সাধারণের শিল্পী ॥ সুলতান

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৮ আগস্ট ২০১৭

সাধারণের শিল্পী ॥ সুলতান

প্রচণ্ড আকাক্সক্ষা এবং মানসিক শক্তি দ্বারা সৃষ্টির বেগময়তা নিয়েই পৃথিবীতে কিছু প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় আর তেমনি একজন অক্ষয়প্রাণ শিল্পকার হলেন- এসএম সুলতান। দেশের সাধারণ জনগণ যা বুঝবে আজীবন তাই চিত্রপটে তুলে এনেছেন সহজ সরল ভঙ্গিমায়। উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করেছেন সদা সর্বদা। বাঙালীর সংগ্রামী জীবনের দাম্ভিক সংবেদনা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাঁর চিত্রে। মূলত কর্মিষ্ঠ চাষীই ছিল সুলতানের অন্যতম অম্বিষ্ট। তিনি দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করতেন ফসলের রূপকার অর্থাৎ কৃষকরাই বাংলার সভ্যতার জনক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁর বোধের পরিধি ছিল সুবিস্তৃত। অত্যন্ত দূরদর্শী দৃষ্টি সম্পন্ন আধ্যাত্ম মনোনিবেশিত এই শিল্পী দেশের মানুষ যা বুঝবে তাই এঁকেছেন বোধগম্যের অবয়বের আলিম্পনে। গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষি কাজের ছন্দবাধা গীত ছিল তার প্রাণের সুর। বাঙালীর দোহ ও প্রতিবাদ বিপ্লব সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস-ই হয়েছে তাঁর কাজের মূল অনুপ্রেরণা। তাঁর অবয়বধর্মী সৃষ্টিগুলো নিম্নবর্গীয় মানুষের-ই প্রতিনিধিত্বকারী। শক্তিশালী আশাবাদী প্রতিবাদী শ্রমজীবী কর্মঠ কৃষকেরই জয়গান গেয়েছেন। চিন্তা চেতনা বিশ্বাসে সুলতান একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন। এক স্থানে শিকড় ছড়িয়ে বসায় ঘোর অনাগ্রহ ছিল তাঁর, অলসতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এক মুহূর্তের জন্য। মানুষ শক্তিমত্তায় অনেক বড়, পুরো পৃথিবীর খাদ্য যোগানে কৃষক সম্প্রদায়ের যে অবদান, প্রগাড় সাহসী জীবনবোধের একনিষ্ঠ চিত্রকর সুলতান তা ভালভাবেই অনুভব করতে পেরেছেন। তাই তো এই কৃষককে আদি পিতা আদম রূপে রূপদান করেছেন, কখনও আবার শক্তিমত্তার এমন রূপ দিয়েছেন যাতে ফুটে উঠেছে আশীর্বাদের আভা। কখনই বাংলার কৃষকদের দুঃখ দরিদ্রতাকে বা স্বাস্থ্যহীন রুগ্ন কৃষক রূপে প্রকাশ করতে চাননি। কৃষকরা বিশালদেহী, পেশিবহুল কৃষাণী সুডৌল ও সুঠামদেহী এমনকি হালের বলদকেও রিষ্ট পুষ্ট করে এঁকেছেন। কারণ কৃষক হালচাষের মতো কঠিন কাজ করে কঠোর কট্টর জমিতে মাটিকে কোমলতা দান করে পানি সিঞ্চনে রসবতী করে শস্য ফলানোর উপযোগী করে। মাটি ও কৃষকের দ্বৈত সম্পর্ককে বলিষ্ঠ করে না আঁকলে সম্পূর্ণতা সাধিত হয় না। তাই তো ভেবেছেন রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা লাবণ্য ও শক্তিরূপ যুগপত করে না তুললে কৃষকের প্রতি অন্যায় হয়। জীবন সংগ্রাম, বাঙালীর শক্তিশালী ও পুরুষ দীপ্ত পুরুষ ও সুগঠিত নারী অবয়ব জীবনবাদী ও সংসারাশ্রয়ী জন মানুষ ও তাদের জীবন চিত্রকে নিসর্গ, প্রকৃতি সমন্বয়ে উপস্থাপন করতেন ধান কাটা, ধান ভানা, ধান ঝাড়া, মাছ ধরা, মাছ কাটা, কাপড় ধোয়া, প্রথম বৃক্ষ রোপণ, যাত্রা প্রভৃতি ছবিগুলোতে বাস্তবতার স্বচ্ছ রচনা তৈরি করেছেন। বাংলার পলি কতইনা উর্বর চাষী তাতে দিগন্ত জোড়া সোনালি ফসল ফলায়। সেই সোনা ধান জমির জন্য বল্লব, ঢাল, তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ সংগ্রামেও লিপ্ত হতে পিছপা হয় না এই রুদ্রমূর্তি কৃষক। যার রূপায়ন দেখা যায় চর দখল চিত্রে। অধিকৃত জমির একাংশ ও ছাড়তে নারাজ, ফসলের জমি রক্ষার্থে বিপুল বেগে সম্মুখপানে ধাবমান লড়াইয়ে মাটিই তাদের প্রাণ আর মাটির স্বত্বার অধিকার কিঞ্চিৎ পরিমাণে ছাড়তে প্রস্তুত না। বিষয়বস্তুতে তাই পরিপূর্ণতা ও প্রাণ প্রাচুর্যের পাশাপাশি দেখিয়েছেন গ্রামীণ অর্থনীতির শ্রেণী দ্বন্দ্ব রুঢ় বাস্তবতা। পরাধীনতার শেকল ভেঙে প্রগতির প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক অবক্ষয় ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি পেতেই তাঁর চিত্রে শ্রমজীবী কৃষক, জেলে বড় শক্তিশালী বলিষ্ঠরূপে রূপায়িত হয়েছে। শিল্পী এস এম সুলতানের অবয়ব নির্ভর ছবিগুলোতে নর নারী আবেদনময়ী বা কামনার জাগরণ ঘটায় না বরং এক গভীর অনুভূতির জন্ম দেয় বিবেকে। সুলতানের হাতেই বাংলাদেশের প্যাস্টোরাল শিল্পের পুনরুত্থান ঘটেছে। আত্মভোলা ও ভাবুক এই শিল্পী কাঠ কয়লা, কাঁচা হলুদ এমনকি পুঁইশাকের পাকা বিচির রস দিয়েও ছবি আঁকতেন। মেটে সবুজ ও বাদামি, খয়রী এবং মিশ্র চাপা প্রকৃতির রঙ ব্যবহার করেছেন অবয়বে তবে প্রকৃতি এঁকেছেন উজ্জ্বল রঙে। শিল্পের ইতিহাসে অতিরঞ্জনের দিক থেকে মাইকেল এঞ্জেলোর যেমনটা স্বতন্ত্র স্থান রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে শিল্পী এস এম সুলতানের রয়েছে স্বতন্ত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। ফলে তাঁর কাজে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্পী ভ্যানগগ, গগ্যার প্রভাব থাকলেও উপস্থাপন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মানব মূর্তির গঠন রূপায়নে তাঁর বিকাশমান দক্ষ হাতের সুনিপুণ স্বাক্ষর লক্ষণীয় তাই তো পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাকের মতো বিশ্বখ্যাত আধুনিক পশ্চিমি শিল্পীদের চিত্রকর্মের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছিল শেখ মহাম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম। অরণ্য গুহাবাসী মানুষ সদ্য কৃষিকাজ শিখে ঘর তুলেছে, জীবনের স্থিতি খুঁজছে, বৃক্ষ, পশুপাখি, মানুষ অভিন্নাত্মার বলয় তৈরি করে রেখেছে। পশুপাখির প্রতি প্রীতি বৃক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষ এক সময় অস্তিত্ব সংরক্ষণের যে মন্ত্র শিখেছিল সেই প্রতœ পৃথিবীকে চিত্রায়িত করেছেন এই শিল্পী। বাঙালীর সভ্যতার প্রতœ মনীষা পুনরুদ্ধার করতে গিয়েছেন বলেই তাঁর ছবির মানুষগুলো আজকের যুগের মানুষের প্রামাণিক না। তাঁর চাষীরা, আঁশ বটিতে মাছকাটা জেলেনিরা বিপুলদেহী, শরীর গাঁটপড়া মাংসপেশি স্ফীত যা সাহসী, প্রত্যয়ী,পরিশ্রমী এবং প্রতিকূলতার মোকাবেলায় দৃঢ় সংকল্প বদ্ধতায় প্রকাশিত হয়েছে। আর সুলতানের মতো এ সকল বিষয়ের এরূপ উপস্থাপনের পারমিতা দেখাতে পারেনি কেউই। তাই তো স্বপ্নে লালিত বাংলাদেশ সুলতানের দৃষ্টিতে সচেতনভাবে ধরা দিয়েছে সাধারণ জনগণের কাছেও একইভাবে, যা বিশ্ব দরবারে আজও বহুল সমাদৃত।
×