ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানি শুল্ক হ্রাসের ঘোষণায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মাথায় বাজ পড়ছে! ;###; কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম থেকে আসছে চাল- বন্ধ হবে মিল মালিক ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে আড়তদার পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর

চাল সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে ॥ দাম কমবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ আগস্ট ২০১৭

চাল সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে ॥ দাম কমবে

এম শাহজাহান ॥ বন্যা পরিস্থিতির মুখে বাজার সামাল দেয়ার লক্ষ্যে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে নানামুখী তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। আমদানি শুল্ক ৮ শতাংশ কমানোর ঘোষণা আসার পর থেকে চালের সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের মাথায় বাজ পড়তে শুরু করতে করেছে। ইতোমধ্যে চালের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্কহার কমিয়ে ২ শতাংশ অবনমিত করার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বাড়বে আমদানি, মজুদ চাল আসবে বাজারে। আমদানি শুল্ক উঠে যাওয়ায় মিল মালিক ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে। আড়তমালিক, পাইকারি ও খুচরা পর্র্যায়ের চালের ব্যবসায়ীদের দিকে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আসছে। এসব উদ্যোগের ফলে শীঘ্রই চালের দাম কমে আসবে বলে মনে করছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এনবিআর তাদের প্রজ্ঞাপনে বলেছে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় চাল আমদানির প্রযোজ্য শুল্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ওই আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মুখে দেশের চাল উৎপাদনে যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনা শেষে সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, চাল আমদানির ওপর শুল্কের হার ১০ শতাংশ হতে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারিত হবে। জানা গেছে, অতিবৃষ্টি এবং বন্যা পরিস্থিতির কারণে এ বছর ধান ও চালের উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণ নাও হতে পারে। এছাড়া গত কয়েক মাস ধরে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম বেড়ে গেছে। এই বাস্তবতায় শুল্ক কমানোর ফলে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির পাশাপাশি দেশে মজুদকৃত চালও বাজারে চলে আসবে। বন্যা পুঁজি করে দেশে কেউ খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টির সুযোগ নিতে পারবে না। চালের বর্তমান বাজার মূল্য এবং মজুদ নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ভারি বর্ষণ ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে দেশে চালের দাম যাতে আর না বাড়ে সেজন্যই আমদানি শুল্ক নামিয়ে আনা হয়েছে। ৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে বেসরকারী পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশ থেকে সস্তায় চাল আনতে পারবেন। এছাড়া সরকারের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়েছে। সবমিলিয়ে বন্যার সময় দেশে কোন চালের সঙ্কট হবে না এবং দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি বলেন, সরকার ১৫ লাখ টন চাল এবং ৫ লাখ টন গম আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব চাল ও গম দেশে আসা শুরু হলে এমনিতেই দাম কমে যাবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিক ভর্তুকির অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিজাত সামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ২০ শতাংশ হারে ছাড় প্রদান করা হয়েছে সেচযন্ত্র ও বিদ্যুত বিলের ওপর। বর্তমান কৃষি যান্ত্রিকীকরণে উন্নয়ন সহায়তার হার হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং দেশের অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এপ্রিল মাসের আকস্মিক বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং কিশোরগঞ্জ এলাকায় খাদ্যশস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সারাদেশের খাদ্য উৎপাদন মোটামুটিভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানা গেছে, আগে থেকে নজরদারি না থাকায় চালের মজুদ পর্যাপ্ত রাখতে পারেনি সরকার। এ কারণে গত দুই মাস চালের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকারের সংস্থাগুলো। ফলে চাল কিনতে চড়া দাম দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বর্তমানে বাজারে সর্বনিম্ন দামে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪- ৪৬ টাকায়। মাঝারি মানের চাল বিআর আটাশ ও লতা ৪৮-৫০ টাকা ও পাইজাম ৫০ থেকে ৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইলের কেজি এখন ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা। তবে ভাল মানের নাজির ৬০ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া আতপ চাল এখন কেজি ৫০ টাকা। চালের দাম উর্ধমুখী স্বীকার করে খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, দাম বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, মিল মালিক, মজুতদার কারসাজি করে চালের দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার চাল আমদানি করছে। এছাড়া চালের আমদানি শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হচ্ছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের কারণে চালের দাম শীঘ্রই কমে আসবে। সূত্রগুলো বলছে, চলতি অর্থবছরে সরকার যে পরিমাণ ধান-চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সারা দেশে বন্যার কারণে তা অর্জন শেষ পর্যন্ত সম্ভব নাও হতে পারে। আর তাই আমদানি উৎসাহিত করতে দুই মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া বড় বন্যা পরবর্তী খাদ্য মজুদ বাড়াতে সরকার চলতি অর্থবছরে বিদেশ থেকে ১৫ লাখ টন চাল ও ৫ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এবছর এক কোটি ৯১ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু হাওড় এবং অন্যান্য এলাকার বন্যার কারণে তা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে যে সাত লাখ টন ধান ও ৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেটাও সম্ভব হয়নি। এ পর্যন্ত মাত্র ২ লাখ ৭০ হাজার টন ধান ও চাল সংগ্রহ করা গেছে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে দুই লাখ ৬০ হাজার টন চাল ও অন্যান্য দেশ থেকে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার টন গম এসেছে। সরকারী পর্যায়ে ভিয়েতনাম থেকে যে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির যে চুক্তি হয়েছিল, তার বেশির ভাগ অংশ চলে এসেছে। বাকিটাও এ মাসের মধ্যে চলে আসবে। কম্বোডিয়ার সাথে আড়াই লাখ টন চালের চুক্তি হয়েছে। শীঘ্রই চুক্তিপত্র ক্রয় কমিটিতে অনুমোদনের জন্য তোলার কথা। সরকারীভাবে চাল আমদানি ছাড়াও টেন্ডারের মাধ্যমে সাড়ে তিন লাখ টন চাল আসছে। এর মধ্যে তিন লাখ টনের চুক্তিপত্র হয়েছে, বাকি ৫০ হাজার টনের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছরই চালের মজুদ সবচেয়ে কম। গত ২০১১-১২ অর্থবছরের এই সময়ে চালের মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার টন। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৬ লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ৬ লাখ ৫৮ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সময়ে ছিল ৬ লাখ ৯৬ হাজার টন। এবারই প্রথম চালের মজুদ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে সরকারের আগেই পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। এ বিষয়টি আগে থেকেই গুরুত্ব দিলে এখন মজুদ পরিস্থিতি এমন হতো না। ব্যবসায়ীদের কারণে এই কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এতে চালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, চালের দাম ওঠানামার ক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই। মিল থেকে কেনা দামের সঙ্গে প্রতি কেজিতে ১ টাকা পরিবহন ব্যয় ও ১ টাকা অন্যান্য খরচ ধরা হয়। এর পরে ৫০ কেজির বস্তায় ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভে বিক্রি করেন তারা। এতে মোটা চাল পাইকারিতে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে।
×