ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

কবিতা বনের চিরহরিৎ বৃক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ আগস্ট ২০১৭

কবিতা বনের চিরহরিৎ বৃক্ষ

সময় স্বভাবতই কবিকে প্রভাবিত করে। তাই সময়ের রেখাপাত কবির শব্দবন্ধ জুড়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যখন ভাষা, স্বদেশ বা জাতিগত চেতনা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে কবিও দৃঢ়, দীপ্ত ভঙ্গিতে কথা বলেন, কথা বলে ওঠে তার কবিতাও। এ জন্য আমরা আন্দোলন সংগ্রামের প্রেক্ষিতে কবিদের কাছ থেকে জাগরণ, উদ্দীপনা, প্রতিবাদ ও দ্রোহের অসংখ্য কবিতা পেয়ে থাকি। যেসব কবিতায় থাকে আন্দোলনের পক্ষে শক্তি, সংগ্রামের পথে সাধনা, অন্যায়-অবিচারের প্রতি চরম ঘৃণা। এ বিষয়কে সামনে রেখে আলোচনা অব্যাহত রাখলে বাংলা সাহিত্যের যে কবির মুখ মনের পর্দায় প্রথম ভেসে ওঠে তিনি শামসুর রাহমান। তিনি বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামে যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছেন এবং তার প্রভাব কবিতায় যেভাবে পড়েছে, সেভাবে অন্য কারও কবিতায় পড়েনি। রাহমান কলমের কালিকে রক্তে পরিণত করে লিখেছেন এক একটি কবিতা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তাই বলে তার কলম থেমে থাকেনি। তার লেখা মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কবিতাগুলোর কথা বলতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থের কথা। দীর্ঘ ৯ মাসের করুণ, বীভৎস, হৃদয়বিদারক বর্ণনা উঠে এসেছে এ কাব্যের কবিতাগুলোতে। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে কবি ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের ভূমিকায় লিখেছেন : ‘তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সুদীর্ঘ ৯ মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগত বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ঙ্কর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্য। নীরন্ধ শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ, ফৌজি জীপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আমরা এই নিয়েই ঢাকা ছিলাম তখন। আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোন কোন রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্কে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে।’ এমন আতঙ্কের মধ্যে থাকলেও অসংখ্য বাঙালীর মতো স্বাধীনতার জন্য কবির আকাক্সক্ষা দমে যায়নি। তাই তো তিনি স্বাধীনতাকে দেখেন নানা রঙে, রূপকে, উপমায় ‘স্বাধীনতা তুমি/বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রং।/স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।/স্বাধীনতা তুমি/গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,/হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।’ স্বাধীনতার জন্য বাঙালীর ত্যাগ এক কিংবদন্তি। বাঙালীর তিতিক্ষা হৃদয়ের হাজার বছরের সংগ্রামনিসৃত। যোদ্ধারা জানে স্বাধীনতার জন্য যে প্রাণ দেয়, তাকে মৃত্যু স্পর্শ করতে পারে না। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ মিশে আছে এ দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে। স্বাধীনতার জন্য এই যে বিসর্জন, তা বেশ ক’টি কবিতায় শামসুর রাহমান তুলে ধরেছেন। তবে তার রচিত এ ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতাটি অগ্রগণ্য। কবির চোখে স্বাধীনতা আসবে বলে সাধারণ মানুষের ত্যাগ, বিসর্জন : ‘তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,/শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো/দানবের মতো চিৎকার করতে করতে/তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,/ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল/আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।/তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।’ শামসুর রহমানের কবিতায় স্বাধীনতা প্রত্যাশী মানুষের আকাক্সক্ষা ও আত্মত্যাগ যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে হানাদারদের নৃশংসতা ও বর্বরতা। এমন নৃশংসতার মধ্যেও স্বপ্নের আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল মুক্তিযোদ্ধারা, গেরিলারা। তাই তাকে দেখি তিনি ‘গেরিলা’ কবিতায় গেরিলাদের তিনি সন্তান হিসেবে সম্বোধন করেছেন। তাদের বীরত্বে, সাহসে কবির মনও আশা জাগানিয়া হয়ে ওঠে। কবি জানেন এই গেরিলারাই একদিন বাংলার দুঃখ হানাদারদের তাড়াবে : ‘তুমি আর ভবিষ্যত যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর।/সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া/তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।’ ‘মধুস্মৃতি’, ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’, ‘তুমি বলেছিলে’ কবিতার মতো আরও অসংখ্য কবিতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা। শামসুর রাহমানের সহজ-সাবলীল-নাগরিক বয়ানে এ কবিতাগুলো হৃদ্ধ করেছে বাংলা কবিতাকে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। রাহমান নাগরিক কবি। নগরকে তার মতো করে ঐভাবে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। ব্যক্তি জীবনেও তিনি আপাদমস্তক শহুরে ছিলেন। তার বলার ভঙ্গি ও কবিতার উপকরণ তাই স্বভাবসুলভ নগরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। বাংলা কবিতার নাগরিক সভ্যতা শামসুর রাহমানের কবিতাকে কেন্দ্র করেই সমৃদ্ধ হয়েছে। অল্প কিছু সময় বাদ দিলে শামসুর রহমান তার দীর্ঘ জীবন ঢাকা শহরে যাপন করেছেন। ফলশ্রুতিতে তার নগরকেন্দ্রিক কবিতা তার নিজস্ব ঢংয়েই বেড়ে উঠেছে। তিনি শহুরে দালানকোটা, নিষ্প্রাণ পাথরে প্রাণ দিয়েছেন। তার কবিতায় বাস, পাকা রাস্তা, রোড লাইট, বাজার, পার্ক, অলিগলি, মার্কেট, ঘুপচি, রেস্তেরাঁÑইত্যাকার নাগরিক শব্দের বহুল প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেখানে গ্রামের নিসর্গ ও প্রকৃতি দেখে সবাই মুগ্ধ, সেখানে শামসুর রাহমান মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন নগরের সৌন্দর্য। শহরের নিসর্গ তাকে বার বার টেনেছে। শহরের পরিবর্তনও কবি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কখনও শহরের প্রতি যে তার বিতৃষ্ণা লাগেনি এমনটিও নয়। কখনও কখনও তিনি শহর ছাড়তে চাইলেও পরে সেই ইচ্ছাকে দমন করেছেন। স্মৃতিমাখা বেড়ে ওঠার শহর ঢাকাতেই তিনি স্থির থাকেন : ‘আঁধারের রহস্যময় প্রাচীন তারার স্বপ্নে দয়ালু উজ্জ্বল নৈকট্যের স্মৃতিতে উষ্ণ চিরকাল। বুঝি তাই ফিরে আসি বার বার তেতো হয়ে আসা চুরুটা মুখে চেপে।’ শামসুর রাহমান তার কবিতায় বার বার শহরকে নানা মাত্রিকতায় দেখতে চেয়েছেন। ছোট ছোট বিষয় আশয়ও তার দৃষ্টি থেকে এড়ায়নি। মূলত কবির সুখ-দুঃখ, অভিজ্ঞতা, পথচলা এই শহরকে ঘিরেই। কবিতায় রাহমানের নাগরিকতার স্বরূপ বুঝতে পাঠকের সুবিধার্থে কটি পঙ্ক্তি তুলে দেয়া হলো : ক) ‘বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি সম্প্রতি আমরাই/শহরে বাগান চাই লিরিকের প্রসন্নতা ছাওয়া।’ খ) ‘বরং পার্কের বেঞ্চে সময় কাটাই চলো কথোপকথনে/চলো পার্কে বৃষ্টির আদর মাখি চোখে মুখে...’ গ) ‘এ শহর চতুর্দিকে ভিড় চতুর্দিকে/বামনেরা জটলা পাকায়।’ ঘ) ‘মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে/সাধের আশ্রয়ত্যাগী হয়/মৌমাছির ঝাঁক/তেমনি সবাই পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগি¦দিক।’ ঙ) ‘আমি কি কখনো জানতাম এত দ্রুত/শহরের চেনা দৃশ্যাবলি লুপ্ত হয়ে যাবে?’ যেহেতু রাহমান তার দৈনন্দিনতাকে কবিতায় স্থান দিতেন, তাই শহর অসংখ্যবার স্থান পেয়েছে তার কবিতায়। নগর, নাগরিকতা হয়ে উঠেছে তার কবিতার বিশেষ উর্বরভূমি। রাহমান প্রথম যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি ত্রিশের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসুর চিন্তা তাকেও পেয়ে বসেছে। শামসুর রহমান তার প্রথম কবি জীবনে ঠিক করেছিলেন তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখবেন না। কারণ ত্রিশের কবিদের মতো তারও ধারণা ছিল রাজনৈতিক কবিতা কখনও শুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু সময়ের টান অথবা রাজনীতি কি উপেক্ষা করা যায়? রাহমান তার রাজনৈতিক কবিতা সম্পর্কে নিজে লিখেছেন : ‘যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে। সেকালে, বলা যায় আমার ধারণা ছিল যে, কবিতা ও রাজনীতির মধ্যে অহিনকূলের সম্পর্ক বিদ্যমান। ...অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য-জ্ঞান করতাম। ...আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। ...আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আমার কাব্যপ্রয়াস একটা নতুন বাঁক নেয় বলে মনে করি। যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠল বহির্জীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি মনস্ক। কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ করে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান।’ এই যে সময়ের ডাকে সাড়া দেয়া, রাজনীতি মনস্ক হওয়া ও সময়ের দাবি মেটানো তা সব কবি সফলভাবে পারেন না। যারা কবির দায়বোধে বিশ্বাসী, যারা শিল্পের দায়কে বিশেষভাবে দেখেন তাদের কাছে শামসুর রাহমান সফল একটি নাম বলেই বিবেচিত হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কবির কণ্ঠ সব সময় ছিল সরব। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। এ ঘটনা তীব্র আলোড়িত করে কবিকে। প্রতিকূল সময়ের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে কবি কলম ধরেন। লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। আসাদের রক্তমাখা শার্ট হয়ে উঠেছিল আমাদের সাহস, আমাদের পতাকা : ‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক; আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ এ প্রসঙ্গে নূর হোসেনকে নিয়ে লেখা ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটিও সমানভাবে স্মরণযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।’ এ কবিতায় তৎকালীন নষ্ট সময়কে নানা নামে, উপকরণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবির ভাষ্যে : ‘কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার মনে হয় যেন উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে যেখানে এখন কেউ কারও চেনা নয়, কেউ কারও ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ, হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায় বৃথা যায়।’ একাত্তরে যারা দেশের সঙ্গে মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল, সেই রাজাকাররাই দেশ স্বাধীনের কিছুটা সময় পরে আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পেলো। রাজকারদের পদচারণায় আবার ভারি হয়ে উঠতে শুরু করল শহীদের ভেজা মাটি। কবি শামসুর রাহমান এই অবস্থার প্রেক্ষিতে লিখলেন ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতাটি। এই কবিতার ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ এতই শক্তিশালী যে, যা যে কাউকেই স্পর্শ করবে। সেই সময়ের প্রতি সৃষ্টি হবে বিরূপ ভাব। কবির মোনাজাত : ‘হে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে/এমন তৌফিক দিন যাতে আমি/আপাদমস্তক মনেপ্রাণে একজন খাস রাজাকার হয়ে যেতে পারি রাতারাতি। তাহলেই আমি সাত তাড়াতাড়ি/মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যাবো, এই চর্মচক্ষে/দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর/ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকীর মতো/এসে যাবে সব পেয়েছির দেশের সওগাত।/তবে সেজন্যে দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে, হাত/কচলাতে হবে অষ্টপ্রহর আর জহরতের মতো/পায়ের চকচকে জুতোয় চুমো খেতে হবে নানা ছুতোয় সকাল সন্ধ্যা/এবং মাঝে মাঝে শিন্নি দিতে হবে পীরের দরগায়।/না, না, এতে জিল্লতি নেই একরত্তি, বরং চোখ-ঝলসানো/জেল্লা আছে এই জীবনে। হে আলেমুল গায়েক, হে গাফফার,/আপনি আমাকে এক্ষুণি/একজন চৌকশ রাজাকার করে দিন। তাহলেই আমি/চটজলদি গুছিয়ে নেবো আখের।’ রাহমানের রাজনীতির কবিতা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সর্ব সাধারণের অনুভূতি হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি শামসুর রাহমান ত্রিশের কবিদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু এ ঘোর তাঁর বেশিদিন থাকেনি। পঞ্চাশের দশক শেষে ষাটের দশকে পা রেখেই রাহমান নিজস্বতা খুঁজে পান। তাঁর নিজস্ব ভাষা ও উপস্থাপন তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। অনেক গবেষকই বলেন, ত্রিশের পরের কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। ত্রিশের কবিদের কবিতা সম্পর্কে দুবোর্ধ্যতার যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেই একই অভিযোগ শামসুর রাহমানকে পেয়ে বসেনি। তাঁর কবিতার প্রথম পাঠেই তিনি কী বলতে চেয়েছেন তা উপলব্ধি করা যায়। প্রেমের কবিতাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে তাঁর প্রাপ্তির চেয়ে তার কবিতায় বিরহ বেদনাই বেশি উচ্চকিত হয়েছে। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নিজেকে দায়ী করেছেন : ‘ভালোবাসা তুমি ক্ষত-চিহ্নিত/পাতাহারা আজ, তোমার কী দোষ বলো?/ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি/ ঢালিনি শিকড়ে একবিন্দু জলও’। আবার কখনো একান্ত ব্যাকুলতায় তিনি বলেছেন ‘জ্যোৎস্না লুটিয়ে পড়লে তোমার ঘরে, তোমার বলার অধিকার আছে, ‘এ জ্যোৎস্না আমার’ কিন্তু চাঁদিনী থাকবে নিরুত্তর। মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক? তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’। তীব্র আকাক্সক্ষার কারণেই হয়ত প্রেমের বেদনা তাঁকে বার বার ছুঁয়েছে। তিনি যতই বলেছেন ‘তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না’, ততই তাঁকে ভুলতে হয়েছে। নানা উপমায় কবি তাঁর প্রিয় মানুষটিকে দেখেছেন। তাকে চিত্রায়িত করেছি অনির্বচনীয় সৌন্দর্যে তোমার সিঁথি দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ, দেখছো/ তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রুপালি শহর।’ রাহমানীয় প্রেম এ কারণেই ব্যতিক্রম। তাঁর প্রেম প্রাপ্তিতে যতখানি না সফল, অপ্রাপ্তিতে তারচেয়েও বেশি সফল। বোধকরি কবি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হৃদয়ের ধারক ও বাহক বলে আর পাঁচ-দশজন মানুষের চেয়ে জাগতিক দুঃখ ও বেদনাবোধ বহুগুণ ভারি হয়ে কবির অন্তরে বাজে। বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্পী হিসেবে শামসুর রাহমানের বাইরে ছিলেন না। তাঁর বেদনাহত হৃদয়ের দাহছাপ যেমন আছে তাঁর কবিতায় তেমনি আছে কাব্যের নামকরণে ও আত্মজীবনীর নিঃসঙ্কোচ বয়ানে। শামসুর রাহমান প্রথম কবিতা লিখেছিলেন পোগোজ স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। কিভাবে, কিসে প্রভাবিত হয়ে শামসুর রাহমান লিখলেন তাঁর প্রথম কবিতাটি অথবা জানার আগ্রহ প্রকট থাকে রাহমানের প্রথম কবিতার ভাব ও বিষয় কী ছিল? রাহমান তাঁর প্রথম কবিতাটি লিখেন তাঁর ছোটবোন নেহারের মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে। বোন হারানোর বেদনাকে তিনি সেদিন তাঁর কচি হৃদয় থেকে প্রকাশ করেছিলেন কবিতার অক্ষরে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিন্নমুকুল’ অনুসরণে লেখা কবিতাটি রাহমান তাঁর মাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন আর এ কবিতা শুনে হু-হু করে কেঁদেছিলেন কবির মা আমেনা খাতুন। কিশোর বয়সে যে দুঃখবোধ থেকে শামসুর রাহমান প্রথম কবিতাটি লিখলেন, বিশ শতকের অন্যতম সফল কবি হয়েও তিনি কি দুঃখবোধ থেকে দূরে থাকতে পেরেছিলেন? উত্তর নেতিবাচকই। তবে তা কেবল শামসুর রাহমানের বেলাই নয়, অন্য সব কবিদের বেলায়ও। উত্তরে বেশি হের-ফের হয়ত হবে না। ‘কবির জীবন’ কেমন তা শামসুর রাহমান নিজেই আমাদের জানিয়েছেন তাঁর কবিতায়Ñ‘কবির জীবন নয় পুষ্প ছাওয়া পথ, পেরেকের/ মতো কাঁটা সর্বত্র ছড়ানো, এমন কি অগ্নিময়/ পথ অতিক্রম করে তাকে বহুদূর যেতে হয়/ বিপদের সঙ্গে লড়ে, অন্তহীন কায়ক্লেশ, ঢের/ মনোকষ্ট সয়ে, সাপ ফুঁসে উঠে গহীন বনের/ ছায়াচ্ছন্ন ছমছমে পথে আর ক্ষণে ক্ষণে ভয়/ সমুখে হাজির হয় নানা রূপে।’ শামসুর রাহমানের বেদনাবোধ কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, বরং এর সীমানা সমাজ থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে বিশ্ব অব্দি ছড়ানো। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের পাশাপাশি সমাজের অবিচার, শোষণ, পীড়ন ও লাঞ্ছনার দৃশ্যগুলো কবি হৃদয়কে বারবার ব্যথিত করেছে, করেছে কষ্টবাণে ক্ষতবিক্ষত। বাংলার মানুষরা যেমন শোষণ, নিপীড়ন, নির্মমতায় দগ্ধ ছিল, তেমনি ছিলেন কবিরাও; তখন এ কষ্টের বহিঃপ্রকাশে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন (স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক) অজস্র কবিতা। শত হৃদয়ের কষ্ট-যন্ত্রণা কবিতার স্বরে সেদিন বেজে উঠেছিল রাহমানের কণ্ঠে, বেদনার্ত হৃদয়ের বাহক হয়ে কবিতা কথা বলেছিল যোদ্ধার স্বরে। বেদনা, দুঃখবোধ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল শামসুর রাহমানের কবিতায়। অন্তর্দাহ হয়ত কবি নিজের ভেতরই রাখতে চাইতেন। তাঁকে বলতে শুনিÑ ‘অস্থিরতা কয়েদী পাখির/ মতো ডানা ঝাপটায়, কী এক অভিমানে নিজেকেই/ নিমেষে পুড়িয়ে শেষে দুহাতে ওড়াই শুধু ছাই।’ আল মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘শামসুর রাহমান হঠাৎ করেই আমার বাসায় হাজির হতেন। কাউকে কিছু বলতেন না। কেবল চুপচাপ বসে থাকতেন। জিগ্যেস করলে বলতেন, এমনি বসে আছি।’ এরপর আমাদের প্রশ্ন থাকে, কেন কবি এমন করতেন? এমন প্রশ্নের উত্তরও শামসুর রাহমান নিজেই আমাদের জানান ‘কাঁদতে পারি না’ কবিতায়‘বিষণ্ন কেন আমি আজ নিজেই বুঝি না;/ বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কিন্তু কাঁদতে পারি না।’ কর্মজীবনে শামসুর রাহমানের কাক্সিক্ষত শান্তি ছিল না। বার বার তাকে কর্মস্থল পরিবর্তন করতে হয়েছে। চাকরি জীবনের অনিশ্চয়তা, উদ্বিগ্নতা আর দশজনের মতো তাঁকে পেয়ে বসেছিল। বেশ কয়েক জায়গায় তিনি চাকরি করলেও পছন্দের চাকরি তাঁর একটাও ছিল না। এজন্যেই হয়ত তাঁকে আমরা দেখি নিজেকে নিয়ে নিজেই রসিকতায় মেতে উঠেছেন। চাকরির বেতনের টাকা নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘তিনশো টাকায় আমি’ সনেটটি। পারিবারিক জীবনে রাহমান খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তার ছোট ছেলে মতিনের মৃত্যুতে। অতি অল্প বয়সে মতিন পুকুরে ডুবে মারা যায়। রাহমানের জন্য এমন শোক সামলে ওঠা কষ্টকর ছিল। শিশুপুত্রকে নিয়ে তাঁর যে শোক তা উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি কবিতায়। ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতায় রাহমান বলেছেন, ‘বললাম-জিজ্ঞাসু অতিথিকে এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই তখন পাথরের টুকরোর মতন ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে বছর তিনেক আগে কাক ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে। ................ অতিথি বিদায় নিলে আবার দাঁড়াই এসে ফটোগ্রাফটির প্রশ্নাকুল চোখে, ক্ষীয়মান শোকে। ফ্রেমের ভেতর থেকে আমার সন্তান চেয়ে থাকে নিষ্পলক, তার চোখে নেই রাগ কিংবা অভিমান।’ হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছিলেন, শামসুর রাহমান ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’। তিনি হয়ত জীবনানন্দের ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ নন। রাহমান কষ্টকে রূপ দিয়েছেন কবিতায়। অনেক কবিতা পড়লে হঠাৎ মনে হয় এ তো কবিতা নয়, দুঃখের ভিন্ন কোন নাম; বেদনাদাহ হৃদয়ের নামতাবলি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে সকল কবিই সুখ-দুঃখের রূপকার। এর মধ্যে কেউ হয়তো রবীন্দ্রনাথ অথবা কেউ নিখাদ যতীন্দ্রমোহন বাগচী। তবে শামসুর রাহমানকে এদের মধ্যবর্তী পর্যায়ে ফেলা যায়। শামসুর রাহমানের কবিতা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত সম্ভবত হুমায়ুন আজাদই দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ‘সমকালীন বহির্জীবনের সঙ্গে শামসুর রাহমান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন আপন ব্যক্তি তাকে, বারবার ‘আমি’ উচ্চারণ তাঁর স্বভাব, যার ফলে তাঁর কবিতায় রচিত হয়েছে বিপুল পরিমাণ আত্মবিবরণী; আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মকথনে তিনি বাংলা ভাষায় সম্ভবত অদ্বিতীয়;Ñআপন প্রসঙ্গ, অনুষঙ্গ, ব্যক্তিগত জীবন ও প্রতিবেশ, আত্মীয়বান্ধব এবং নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত কিছুই ঢুকে পড়েছে তাঁর কবিতায়।’ হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখায় এও স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, শামসুর রাহমানের আমি সর্বজনের আমিত্বে পরিণত হয়েছে। আর নিজের মধ্য দিয়ে সর্বজনের কথা বলা যে একটি বিশেষ গুণ, তা অস্বীকারের জো নেই। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কবিদের কবি’ গ্রন্থে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান শামসুর রাহমানকে ‘প্রধান কবি’, ‘পরভৃত কবি’ ও ‘পরঞ্জয় কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে, শামসুর রাহমান ‘প্রধান কবি : কারণ, সামগ্রিক বিবেচনায় তাঁর কালখ-ে তিনিই প্রধান কণ্ঠস্বর, আধি ও নিধিতে। পরভৃত কবি : কারণ তাঁর কালের পরিকীর্ণ প্রতিবেশ ও পরিবেশকে তিনি স্যামসনের মতো কাঁধে নিয়ে জয়-পরাজয়-প্রাচুর্যে হয়েছিলেন কালের কোকিল। পরঞ্জয় কবি : কারণ, কালের সকল প্রতিকূলতাকে তিনি দুর্জয় রিপু বলে জয় করে হয়েছিলেন অরিন্দম। কবিতাকে আমরা যদি পেতে চাই সময় চেতনায়, ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ চেতনায় তাহলে তিনি মহত্তম কারিগর।’ শামসুর রাহমান সম্পর্কে এমন ধারণা যে কেবল গাজী আজিজুর রহমানেরÑতা নয়। বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক হুমায়ুন আজাদও তাঁর বিষয়ে বহু আগে একই ধরনের কথা বলেছিলেন। শামসুর রাহমান দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে লেখালেখি করেছেন, সমকালকে ধারণ করে লিখেছেন অসংখ্য কবিতা; মুক্তিযুদ্ধ, নাগরিকতা ও প্রেম তাঁর কবিতায় দীর্ঘপথ হেঁটেছে। আপনসত্তায় উদ্ভাসিত হয়ে দেশ ও কালকে তিনি নিজের করে নিয়েছেন। নাম লিখিয়েছেন কবিতার কারিগর হিসেবে। বিশেষত, তাঁর কাব্যে বাংলাদেশ ও সমকাল যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেÑ অন্য কারও কবিতায় এতটা প্রবলভাবে তা ফুটে উঠেনি। ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নেয়া শামসুর রাহমানের কাব্যখ্যাতি ও সাফল্য যে কারও জন্যেই ঈর্ষণীয়। রাহমান সেই যে পঞ্চাশের দশকে লেখা শুরু করেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি থামেননি। তিনি আজীবন লিখেই যেতে চেয়েছেন। অনেক সমালোচনাও হয়েছে তাঁকে নিয়ে। তাঁর প্রতিবাদী স্বভাবের জন্য বার বার ভোগান্তিতেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। কাজী নজরুলের পরে তিনিই সম্ভবত সেরা মুসলমান কবি। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন। রাহমান ষাটটির অধিক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত বিপুল সংখ্যক কবিতা বাংলা সাহিত্যে আর কেউ লেখেননি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ আরও বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হওয়া এ কবি ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। অন্য সব মহান কবির মতোই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শামসুর রহমান অমৃত ও অমরত্বের পথে হাঁটলেন।
×