ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আরেকটি ভয়াবহ রক্তাক্ত আগস্ট থেকে রক্ষা পেল দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৭ আগস্ট ২০১৭

আরেকটি ভয়াবহ রক্তাক্ত আগস্ট থেকে রক্ষা পেল দেশ

শংকর কুমার দে ॥ আরও একটি ভয়াবহ রক্তাক্ত আগস্ট থেকে রক্ষা পেল দেশ। রাজধানীর পান্থপথের হোটেলে জঙ্গী সাইফুলের বিস্ফোরণ ঘটানো বোমাগুলো ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ও শোকর‌্যালিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হলে বহু লোক হতাহতের ঘটনা ঘটে যেত। শোকের দিবস ১৫ আগস্টে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য জঙ্গী সাইফুল ইসলাম বহু লোক হতাহতের ঘটনা ঘটাতে উঠেছিল রাজধানীর পান্থপথের হোটেলে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগাম তথ্য পেয়ে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে তল্লাশি করে জঙ্গী সাইফুলের নাশকতার পরিকল্পনা ভ-ুল করে দিয়ে দেশকে আরও একটি রক্তাক্ত আগস্ট থেকে রক্ষা করল। রাজধানীর পান্থপথে আত্মঘাতী জঙ্গী সাইফুল ইসলামের শরীর পুড়ে গিয়ে বোমার স্পিøন্টারের আঘাতে চোখ, মুখ মাথা ভেদ করে নিহত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। জঙ্গী সাইফুলের সঙ্গে আরও একাধিক লোক ছিল বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিঞা। জঙ্গী সাইফুলের সঙ্গে আরও যেসব জঙ্গী ছিল তাদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মঘাতী হয়ে নিহত জঙ্গী সাইফুল রাজধানীর পান্থপথে শোক দিবসে আত্মঘাতী বোমা হামলার যে পরিকল্পনা করেছিল তা যদি বাস্তবায়ন করতে পারত তাহলে কত লোক হতাহত হতো তা চিন্তা করলে শরীর কাটা দিয়ে শিউরে উঠে। জঙ্গীর সঙ্গে থাকা তিনটি বোমাগুলো ছিল ব্যাপক শক্তিশালী। এই বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানোর সুযোগ পেলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যেতে পারত, যার থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। তবে শোক র‌্যালিতে বা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের সময়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর বা হামলার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গীরা, তাতে স্বাভাবিকের চাইতে ক্ষয়ক্ষতি হতো অনেক বেশি। হতাহতের সংখ্যা হতো বিপুল সংখ্যক। ফলে হামলার আগেই সাইফুলকে পরাস্ত করতে পারাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাফল্য হিসেবেই দেখছেন অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্র জানান, জঙ্গী সাইফুল ইসলামের কাছে যে তিনটি বোমা ছিল তা খুবই শক্তিশালী ছিল। এগুলো যেহেতু শোক দিবস উপলক্ষে ৩২ নম্বরের গণজমায়েতে হামলার জন্য ব্যবহার করা হতো, তাহলে ঘটনাস্থলেই বহু লোকজন মারা যেত। আহত হতো আরও বহু সংখ্যক ব্যক্তি। জঙ্গী সাইফুল একটি কম দামি ট্রাভেল ব্যাগে করে বোমাগুলো বহন করেছিল। অভিযানে তার মৃত্যু হওয়ায় কোথা থেকে এসব বোমা সংগ্রহ করেছিল, তা জানা যাচ্ছে না। তবে তাদের ধারণা ঢাকার আশপাশে বা ঢাকার ভেতরের কোন আস্তানা থেকেই এসব বোমা সে হামলার জন্য নিজের কাছে নিয়ে থাকতে পারে। হামলার পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে সাইফুল উঠেছিল। হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে হোটেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রবিবার দুপুরের পর সাইফুল নিজ নাম-পরিচয় দিয়েই হোটেলটিতে ওঠে। এমনকি হোটেল কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী নিজের একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপিও জমা দিয়েছিল, যা ফেক আইডি নয় বলে নিশ্চিত হয়েছেন কর্মকর্তারা।’ যদিও এর আগে বিভিন্ন অভিযানে জঙ্গীদের বাসা ভাড়া নেয়ার সময় জমা দেয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপিগুলো ফেক বলে জানতে পারেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, কোণঠাসা হয়ে পড়া নব্য জেএমবি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গী সংগঠনটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকার রুট দিয়ে জঙ্গীরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-বিস্ফোরক আনছে। মাস কয়েক আগে সেই রুটটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন অন্যান্য সীমান্ত পয়েন্ট এবং দেশের ভেতর থেকেই জঙ্গীরা বিস্ফোরকের উপাদান সংগ্রহ করছে। আর এখনও অল্প যে কয়েকজন নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা পলাতক রয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন বোমা তৈরিতে দক্ষও। বোম ডিসপোজাল ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীর পান্থপথের এই হোটেলে যে দুটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে, পরে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট একটি নিষ্ক্রিয় করেছে। এগুলোতে আগের বোমাগুলোর চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে বোমা তৈরির কন্টেনার হিসেবে আগে লোহার তৈরি জিআই পাইপ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখানে কোন জিআই পাইপের উপাদান পাওয়া যায়নি। তবে স্পিøন্টার হিসেবে ছোট ছোট লোহার বল ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া বিস্ফোরক উপাদানের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, তিন তলার সেই হোটেল কক্ষটির দেয়াল ও দরজা ভেঙ্গে পড়েছে। বোমাটি প্লাস্টিকের কোন কন্টেনারের ভেতরে বা কাপড়ের ভেতরেও থাকতে পারে। আরও সহযোগী জঙ্গী ছিল রাজধানীর পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে জঙ্গী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে আরও কয়েক সহযোগী ছিল। ঘটনাস্থলের আশপাশে এদের অবস্থান ছিল। এই তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া। বুধবার দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ‘শব্দ দূষণ ও হাইড্রলিক হর্ন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে জঙ্গী সাইফুলের সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁর সহযোগীদের ধরতে গোয়েন্দারা কাজ করছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে আত্মঘাতী জঙ্গী সাইফুল ইসলাম রাজধানীর পান্থপথের হোটেলে বোমার আঘাতেই নিহত হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। বুধবার পৌনে ৫টায় শুরু হয়। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় বিকাল ৫টা ১৬ মিনিটে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, নিহত জঙ্গীর সারা শরীর পুড়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় স্পিøন্টারের ক্ষত রয়েছে। তার ডান চোখে স্পিøন্টার ঢুকে মস্তিষ্ক ভেদ করে মাথার ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এটাকেই মৃত্যুর জন্য মূল ডেমারেজ বলা হয়েছে ময়নাতদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে। বোমার কারিগর খোঁজা হচ্ছে জঙ্গীদের ব্যাবহারের জন্য বোমাগুলো যারা তৈরি করছে তাদের খোঁজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নব্য জেএমবির শীর্ষ অনেক নেতাসহ বোমা তৈরিতে দক্ষ। দক্ষ বোমা প্রস্তুতকারী জঙ্গীরা গত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হয় ধরা পড়েছে, নয়তো অভিযানে নিহত হয়েছে। কিন্তু এরপরও জঙ্গীদের বোমাগুলো তৈরি করছে কারা সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
×