ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে ...

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৭ আগস্ট ২০১৭

এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে ...

মোরসালিন মিজান ॥ আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/ এসো নির্মল নীলপথে...। এসেছে শরত। ভাদ্র আশ্বিন দুই মাস শরত কাল। এই কালের শুরুটা হলো বুধবার। টানা বৃষ্টি। ভারি বর্ষণ। এমনকি বন্যায় তলিয়ে গেছে দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চল। এ অবস্থায় অনেকেই ত্যক্ত বিরক্ত। বৃষ্টি চাই। তাই বলে এতো? প্রকৃতিপ্রেমী এমনকি কবিরা বলছিলেন, যথেষ্ট হয়েছে। এবার বর্ষা তুমি বিদেয় হও। আর তার পর খুব নীরবেই বিদায় নিয়েছে বর্ষা। বর্ষার যেখানে শেষ, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে শরতের। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আর বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়। শরতেও নতুন করে সাজতে শুরু করেছে প্রকৃতি। একটু একটু করে পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট হবে। বাড়াবাড়ি রকমের বৃষ্টি শেষ হলেই দেখা দেবে আশ্চর্য সুন্দর নীল আকাশ। সেখানে কালো কিছু আর দেখা যাবে না, সাদা মেঘের ভেলা ভাসবে। গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ইতোমধ্যে ফুটেছে কাশফুল। সে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন রোদেলা বিকেল আর নরম বাতাসটুকুুর অপেক্ষা। তবেই দুলবে কাশফুল। দৃশ্যমান হবে। শিউলি ফোটারও এখন সময়। আহা, শিউলি! মিষ্টি ঘ্রাণ নিয়ে শরতেই ফুটবে। ছোট বড় আরও কত পরিবর্তন শরতের হাত ধরে হয়। শরতের এই পরিবর্তন আর প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলাÑ/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাইÑ লুকোচুরি খেলা...। প্রেমের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে কবি লিখেছিলেনÑ এসো শারদপ্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...। শরতের মিষ্টি সকালটির বর্ণনাও পাওয়া যায় তার লেখায়, যেখানে তিনি লিখেছেনÑ শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। শরতে শুধু প্রকৃতি নয়, মনও কেমন যেন বদলে যায়। পরিবর্তিত হয়। সেই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...। নজরুল শরতে হারানো প্রিয়াকে অনুভব করেছেন খুব করে। লিখেছেনÑ শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/ এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...। একইরকম বিরহ আক্রান্ত হয়ে কবি লিখেছেনÑ দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/ শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। প্রায় অভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে কবিগুরু লিখেছেনÑ আজি শরতাপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরাণ কী যে চায়।/ ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। সব মিলিয়ে অন্য রকম আবেগ ভালবাসার ঋতু শরত। প্রতি বছরই এই ঋতুকে নানা আনুষ্ঠানিকতায় বরণ করে নেয় বাঙালী। সংস্কৃতিপ্রেমীরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। কবিতায় গানে বন্দনা চলে শরতের। এবার ওই ভারি বর্ষণের কারণেই প্রথম দিনটিতে তেমন কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। তবে উৎসব প্রস্তুতি চলছে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বাতিঘর ছায়ানট যথারীতি আয়োজন করবে শরত উৎসবের। উদীচী, সত্যেন সেন শিল্পগোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও বরন করে নেয়া হবে নতুন ঋতুকে। এ প্রসঙ্গে সত্যেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজারুল চৌধুরী সুইট জনকণ্ঠকে বলেন, ঋতুভিত্তিক উৎসবগুলো আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। কবিগুরুর চোখ দিয়ে যে শরত দেখা, তার কোন তুলনা হয় না। নতুন প্রজন্মকে আমরা সেই শরত দেখাতে চাই। বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিতে চাই। এ চিন্তা থেকে উৎসব আয়োজন করা। এটি বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব। এমন উৎসব বেশি বেশি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×