ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অদ্ভুতুড়ে’ সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের টাকা যেভাবে কাটে ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৭ আগস্ট ২০১৭

অদ্ভুতুড়ে’ সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের টাকা যেভাবে কাটে ব্যাংক

রহিম শেখ ॥ একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা গাড়ি ঋণ নেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান। শুধু প্রসেসিং ফি বাবদই এ ব্যবসায়ীর নেয়া ঋণের ১ শতাংশ কেটে রাখে ব্যাংকটি। এছাড়া লোনের আবেদন ফি, ডকুমেন্টেশন ফি, লিগ্যাল ফি, মর্টগেজ ফি, হিসাব পরিচালন ব্যয়সহ ১২-১৫ ধরনের চার্জ কেটে রেখে ব্যাংক ওই গ্রাহককে দিয়েছে নগদ ১৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাকি ৬০ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখা হয়। তিন বছরের জন্য নেয়া ওই ঋণ দেড় বছরের মাথায় ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন হাবিবুর রহমান। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে মোট ঋণের ২ শতাংশ হারে আরও ৪০ হাজার টাকা নিষ্পত্তি ফি বাবদ দিতে হয়েছে তাকে। সে হিসাবে ১২ শতাংশ সুদে নেয়া গাড়ি ঋণে ২০ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে এ গ্রাহককে। হাবিবুর রহমানের মতো এমন অনেক গ্রাহকই রয়েছেন, যারা জানেন না সার্ভিস চার্জ বা ফি কত ধরনের হতে পারে। গ্রাহক যেমন না জেনেই ঋণ নিচ্ছেন, ব্যাংক কর্মকর্তাও তেমনি কৌশলে এড়িয়ে যান বাহারি সব সার্ভিস চার্জের তথ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সার্ভিস চার্জ ছাড়াও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করছে ব্যাংকগুলো। কোন গ্রাহককে ব্যাংক এক কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিলেও গ্রাহক পাচ্ছেন গড়ে ৯৮ লাখ টাকা। বাকি দুই লাখ টাকা ঋণ বিতরণের আগেই সার্ভিস চার্জ ও ভ্যাট বাবদ কেটে রাখছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। অথচ ঋণের পুরো টাকা না পেয়েও গ্রাহককে এর ওপর সুদ দিতে হচ্ছে। কখনও কখনও এ সুদের হারও বেড়ে যায় গ্রাহকের অজান্তেই। উচ্চস্তরের সুদ এবং সার্ভিস চার্জের কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যাও কম নয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া এ ধরনের ছোট গ্রাহকদের ওপরই সার্ভিস চার্জের চাপ বেশি। বড় গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে তাদের সার্ভিস চার্জ খুব বেশি দিতে হয়নি। ব্যাংক কর্মকর্তারা নিজে থেকেই সমঝোতা প্রস্তাব দিয়ে অনেক চার্জ কমিয়ে দেন। ঋণের সুদ বাদ দিয়ে এবার সঞ্চয়ী হিসাবে কী পরিমাণ সার্ভিস কেটে নেয়া হচ্ছে সেটা দেখা যাক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর একটি সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে গ্রাহকপ্রতি সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে হিসাব পরিচালন ফি ৬০০ টাকা (প্রতি ষান্মাষিকে ৩০০) ও এটিএমের ডেবিট কার্ড ফি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। হিসাবের শুরুতে চেকবই নেয়ার জন্য দিতে হয় আলাদা চার্জ। কেউ যদি হিসাবের জমার পরিমাণ জানতে চান অথবা কোথাও ব্যাংকসংক্রান্ত কাগজ জমা দিতে হয় তাহলে স্টেটমেন্টপ্রতি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা চার্জ দিতে হয়। তবে বছরে দুবার এ স্টেটমেন্ট ফ্রি দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা দেয়া হয় না। এছাড়া তিন মাস, ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর বা তার বেশি মেয়াদী আমানত রাখছেন গ্রাহক। এসব আমানতের বিপরীতে আগে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ দেয়া হতো। বর্তমানে সুদহার ২ থেকে ৬ শতাংশ। এসব হিসাবের বিপরীতে রয়েছে বিভিন্ন সেবার বিনিময়ে চার্জ। বর্তমানে সব ব্যাংকই অনলাইন ব্যাংকিংসেবা চালু করেছে। এ সেবা না দিলেও চার্জ কেটে রাখে অনেক ব্যাংক। অনলাইন লেনদেন করলে ৫০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা, ডেবিট কার্ড চার্জ ৪৬০ টাকা এবং বার্ষিক চার্জ ৫০০ টাকা। ওই চার্জের বিপরীতে আরও ১৫ শতাংশ হারে সরকারকে ভ্যাট দিতে হয়। সব মিলিয়ে বছরে করসহ চার্জের খরচ দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৩৫৭ টাকা। অর্থাৎ ক্ষুদ্র হিসাবে জমা যতই থাকুক না কেন এটি পরিচালনা করতে বছরে গুনতে হবে ওই টাকা। বিভিন্ন প্রয়োজনে সলভেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হলে ব্যাংক আরও ৩০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ কেটে রাখে। এসব চার্জের বিপরীতেও রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এর বাইরে বিও হিসাব খুলতে বা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে ব্যাংক থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। এগুলোয় কমপক্ষে ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা করে দিতে হয়। এসএমএস পাঠানো ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জন্য বছরে আরও ৫০০ টাকার বেশি কাটা হচ্ছে। কোন গ্রাহক এসএমএস বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা না নিলেও গ্রাহকের কাছ থেকে ঠিকই এ ফি নেয়া হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তফসিলি ব্যাংকের যেসব সেবার সর্বোচ্চ চার্জ আদায়ের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেই সর্বোচ্চ চার্জটিই আদায় করছে ব্যাংকগুলো। অনেক সময় এ সীমার বাইরে গিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ কর্তন করা হচ্ছে। এছাড়া বিও সনদ প্রদান ফি, সাইট এলসি কমিশন, রফতানি বিল নেগোসিয়েশন ও কালেকশন কমিশন, এলসি এ্যামেন্ডমেন্ট, কনফার্মেশন ও ফরেন করেসপন্ডেন্ট চার্জের ক্ষেত্রে মেলিং, কুরিয়ার, টেলেক্স, সুইফট সব ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত চার্জ আদায় করছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বেসরকারী ও বিদেশী ব্যাংকগুলো। একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে সুদহার অনেক কম। বৈশ্বিক নিয়ম হচ্ছে সুদহার কমলে সার্ভিস চার্জ বাড়ে। ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ বাড়ানো উচিত। আমরা খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করব। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক পরিচালনায় নানা ধরনের খরচ রয়েছে। আইটি, অনলাইন, কমপ্লায়েন্স, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, গ্রাহকসেবার মান বাড়ানো ইত্যাদিতে অনেক খরচ করতে হয়। এসব করতে হলে অবশ্যই চার্জ থাকতে হবে। মূল্যস্ফীতির সময়ে সবকিছুর মূল্যই বাড়ছে। কিন্তু ব্যাংকের চার্জ বাড়ানো হয়নি। এখন ব্যাংকের চার্জ বাড়ানো উচিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশে ব্যাংকঋণের সুদহার ব্যবসায়িক প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের সুদহারের তুলনায় বেশি। এ অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস চার্জ যুক্ত হলে ব্যাংকঋণের সুদহার আরও বেড়ে যায়। সব শ্রেণীর গ্রাহকের জন্য ব্যাংকঋণের সুদহার ও সার্ভিস চার্জ সমান হওয়া দরকার। বড়, প্রভাবশালী কিংবা ব্যাংকের পরিচালনা-সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ সুবিধা গ্রহণযোগ্য নয়। মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, কোন্ কোন্ সেবার ক্ষেত্রে ব্যাংক চার্জ নিতে পারবে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছে। চার্জ নেয়ার ক্ষেত্রে কোন ব্যাংক হয়ত কম নেয়, অন্য ব্যাংক বেশি নেয়। সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে একই ধরনের চার্জ থাকে না। অনুমোদিত চার্জের বাইরেও কোন কোন ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে অনৈতিক চার্জ আদায় করে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে কোন ঘটনা হয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক ধরতে পারে, কোনটি ধরতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যাংক সব প্রস্তাবের বিপরীতে ঋণ বিতরণ করতে পারে না। ঋণ বিতরণের জন্য একাধিকবার সরেজমিন পরিদর্শন করতে হয়। এক কোটি টাকা ঋণের ক্ষেত্রে সব ধরনের চার্জ মিলিয়ে এক লাখ টাকাও হতে পারে আবার পাঁচ লাখ টাকাও হতে পারে। গ্রাহককে যেভাবে দিতে হয় বাহারি সব সার্ভিস চার্জ ॥ বিভিন্ন ব্যাংকের জুলাইয়ে ঘোষিত সুদহারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো বড় ও মাঝারি শিল্প খাতের মেয়াদী ঋণের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদ নিচ্ছে। ক্ষুদ্রশিল্পে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ সুদ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এসব শিল্পের চলতি মূলধন ঋণের সুদহারও প্রায় একই। এ সুদহার আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ। ঋণ পেতে হলে ব্যাংক প্রসেসিং ফি দেয়া লাগে। ব্যাংকভেদে এ হার ১ থেকে ২ শতাংশ। ঋণ নিতে গেলে মর্টগেজ অবশ্যই জমা দিতে হয়। মর্টগেজ তৈরির ফি ২ শতাংশের কম নয়। এক থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত মর্টগেজ প্রস্তুত করতে দুই হাজার টাকা ফি লাগে। ২০ লাখ এক টাকা থেকে এক কোটি টাকার মর্টগেজ প্রস্তুতিতে ফি লাগে পাঁচ হাজার টাকা। এরচেয়ে বেশি অঙ্কের মর্টগেজ করতে পাঁচ হাজার এবং প্রতি লাখে ২ শতাংশ হারে ফি দিতে হয়। এর বাইরে রয়েছে সরকারী বিভিন্ন স্ট্যাম্পের নির্ধারিত মূল্য। ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইবি ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এজন্য নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা। ঋণের জন্য ব্যাংকে সুনির্দিষ্ট কিছু কাগজপত্র জমা রাখতে হয়। এজন্য ব্যাংকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা ফি দেয়া লাগে। কোন কোন ব্যাংক এজেন্ট কমিশনও আদায় করে ২ থেকে ৩ শতাংশ। ব্যাংকের জামানতের নিরাপত্তার জন্য দিতে হয় ১ থেকে ২ শতাংশ কমিশন। ঋণের অঙ্ক যত বেশি হবে, কমিশনের অঙ্কও তত বেশি। ধাপে ধাপে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে দিতে হয় কমিটমেন্ট ফি। অবশিষ্ট অংশের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হয়। একজন গ্রাহককে যদি ৫০ কোটি টাকার ঋণ প্রদানের অনুমোদন করে ব্যাংক এবং ওই গ্রাহক ২০ কোটি টাকা নিয়ে বাকিটা পরবর্তী সময়ে নিতে চান তাহলে ওই ৩০ কোটি টাকার ওপর ১ থেকে ২ শতাংশ হারে সুদ আদায় করে ব্যাংক। কোন গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই তার ঋণ পরিশোধ করতে চান তাহলে তাকে বিতরণকৃত ঋণের ওপর ২ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর বাইরে সিন্ডিকেশন ঋণ নিতে হলে গ্রাহককে চুক্তি অনুযায়ী কিছু চার্জ দিতে হয়। এছাড়া নন-ফান্ডেড ঋণের ক্ষেত্রে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু চার্জ। এর বাইরে ঋণ নিতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ব্যাংক হিসাব খুলতে হয়। ওই ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় চার্জসহ ঋণের সুদহার ২০ থেকে ২৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে নেই অদ্ভুত সব সার্ভিস চার্জের তথ্য ॥ ব্যাংকগুলো তাদের কোন্ সেবায় কত চার্জ নেবে আর কোন্ সেবায় চার্জ আরোপ করতে পারবে না এ বিষয়ে সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার অনুযায়ী চার্জ আরোপ করে আসছে ব্যাংকগুলো। তবে সার্কুলার জারির পর ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে নতুন সেবা ও পণ্য।
×