ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশ সফর কমাতে সংশোধিত হচ্ছে নীতিমালা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৬ আগস্ট ২০১৭

বিদেশ সফর কমাতে সংশোধিত হচ্ছে নীতিমালা

তপন বিশ্বাস ॥ সরকরী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক লেগেছে। সরকারী ও দাতা সংস্থার টাকায় তারা বিভিন্ন দেশ সফর করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা, সভা-সেমিনারে যোগদান কিংবা প্রশিক্ষণের অজুহাতে বিদেশ সফর করা হচ্ছে। গত এক মাসে অন্তত ২০টি টিম বিদেশ সফর করেছে। বর্তমানে বিদেশে রয়েছে ১০টি টিম। সরকারী নির্দেশ অমান্য করে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতরা ঘনঘন বিদেশ সফরে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরতে সংশোধন হচ্ছে বিদেশ সফরের নীতিমালা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরতে সংশোধন হচ্ছে বিদেশ সফরের নীতিমালা। সম্প্রতি সচিব সভায় কর্মকর্তাদের ঘনঘন বিদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন এক সচিব। তিনি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর কমানোরও পরামর্শ দেন। এর পরই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান বিদেশ সফরের নীতিমালায় স্পষ্ট কোন নির্দেশনা না থাকায় যে যার ইচ্ছামতো বিদেশ সফর করছেন। এতে সরকারের যেমন আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে কাজকর্মেও দেখা দিয়েছে ধীরগতি। এটি রোধে নয়া নীতিমালার খসড়া তৈরি হচ্ছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অযথা বিদেশ ভ্রমণ নয়। যৌক্তিক কারণ ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি বলেন, বিদেশেও যেতে হবে। দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলে অবশ্যই বিদেশ যেতে হবে। গুরুত্ব বুঝে বিদেশে টিম পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, এছাড়া কর্মকর্তারা বিদেশ গেলে দক্ষতাও বাড়ে। কিন্তু আমাদের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের পর দক্ষতার প্রতিফলন কাজকর্মে তেমন দেখা যায় না। এরই সূত্র ধরে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে তৈরি করা খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রয়োজন অনুসারে শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে যাবেন। সিনিয়র সহকারী সচিব, উপ-সচিব পর্যায়ের কোন কর্মকর্তা বছরে নির্দিষ্ট বারের বেশি বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবেন না। একই কর্মকর্তাকে বারবার বিদেশে না পাঠিয়ে পর্যায়ক্রমে অন্য কর্মকর্তাদেরও বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশ ভ্রমণের পর অর্জিত জ্ঞান কর্মজীবনে কাজে লাগাতে হবে। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অজর্ন করে দেশের জন্য তা উদ্ভাবনী কাজে লাগাতে হবে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকেন। এ জাতীয় ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে এতে। বিদেশ ভ্রমণের আগে যে সম্মেলন বা অনুষ্ঠানের জন্য যাবেন সে বিষয়ে ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে, যাতে বিদেশের মাটিতে গিয়ে যে কোন বিষয় ভালভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়। বিদেশ পাঠানোর আগে প্রতিটি মন্ত্রণালয় কে কী উপস্থাপন করবেন সে বিষয়ে একাধিকবার বৈঠক করবে। বিশেষ কোন সম্মেলনে যেতে হলে প্রয়োজনে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সামনে তা উপস্থাপন করে যেতে হবে, যাতে বিদেশে গিয়ে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন সম্ভব হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিদেশ সফর সীমিত করতে হবে। বিদেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু পদের ক্ষেত্রে একেবারেই সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে পুলিশ সুপার এবং জেলা প্রশাসকদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজ্য হবে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোন সরকারী কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কারণে তিন বছর পর ৩০ দিন এবং দাফতরিক কাজে বছরে চারবারের বেশি বিদেশ সফর করতে পারবেন না। বিদেশ সফরের আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও বিধান থাকছে। দাফতরিক কাজে বিদেশে গেলে তার সর্বোচ্চ সময়সীমা হবে ১০ দিন। বিদ্যমান বিধিমালায় বছরে ছয়বার সরকারী খরচে বিদেশ সফরের নিয়ম রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিগত কারণে তিন বছর পর ৩০ দিন ছুটি নিতে পারেন তারা। এ বিষয়ে জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তারা শুধু বিদেশ সফরে ব্যস্ত- কথাটি ঠিক নয়। প্রশিক্ষণ বা সরকারী কাজে কর্মকর্তারা বিদেশে যাচ্ছেন। তবে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এ সুযোগ বেশি নেন, তাহলে এটি খারাপ। তিনি বলেন, কর্মকর্তারা যত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হবেন, যত বেশি প্রশিক্ষণ পাবেন, প্রশাসনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে শুরু করে প্রশাসনের মূল কর্তাব্যক্তি সচিব পর্যন্ত প্রত্যেকেই বিদেশ যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ বিষয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন মন্ত্রী-সচিবের পিএস-এপিএসরা। মন্ত্রণালয়ের যে কোন ধরনের বিদেশ ভ্রমণে তাদের সফরসঙ্গী হতেই হবে। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে যে কোন সফরের ফাইলে সম্মতি পেতে তাদের হাতে রাখেন কর্মকর্তারা। এমনও দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসে একজন কর্মকর্তা একাধিকবার বিদেশ সফর করছেন সরকারী টাকায়। জানা গেছে, একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সরকারী খরচে গত ৭ মাসে ১১ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, যারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বছরের অর্ধেক সময়ই নানান অজুহাতে বিদেশে থাকছেন। মন্ত্রীর ‘কাছের মানুষ’ হওয়ায় কোন কর্মকর্তাকে এক মাসেই একাধিকবার বিদেশে প্রশিক্ষণ ও সভা-সেমিনারে পাঠানো হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, প্রভাবশালী কর্মকর্তারাই প্রশিক্ষণের নামে ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুযোগ পান। বঞ্চিত হন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মকর্তারা। প্রতি বছর কর্মকর্তাদের বিদেশ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ গ্রহণের হার বাড়লেও সরকারী কর্মকর্তাদের কাজে তার প্রতিফলন কতটুকু পড়ছে, তা নিয়ে সন্দিহান সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
×