ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের দিন শক্তির উৎস

হারানোর দিনে বিস্ময়কর ফিরে পাওয়া, লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৬ আগস্ট ২০১৭

হারানোর দিনে বিস্ময়কর ফিরে পাওয়া, লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠ

মোরসালিন মিজান ॥ তোমার ছবি টাঙাতে পারি না ঘরে,/তাই তো আমার দেয়াল শূণ্য রাখি,/ আমার বুকের গভীর ভালোবাসায়/ উন্নতশির তোমার ছবি আঁকি...। প্রিয় পিতার ছবি বড় ভালবেসে বুকে এঁকে রেখেছে বাঙালী। মুজিব নামের ধ্রুবতারাটি সেই যে জ্বলেছিল, এখনও একই রকম জ্বলজ্বল করছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বড় নির্দয় বড় নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল। কেড়ে নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। অথচ আজ, কী আশ্চর্য, সে দিনটিতেই সবচেয়ে বেশি ফিরে আসেন তিনি। মঙ্গলবারও দেখা গেল অভিন্ন দৃশ্য। চির বিদায়ের দিনে নতুন প্রাণ পেয়েছিলেন শেখ মুজিব। বাংলার প্রতি প্রান্তে এদিন একটি নাম-ই উচ্চারিত হয়েছে। সারা দেশের মতো রাজধানী শহর ঢাকাতেও আর কেউ ছিলেন না। কাউকে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের বহু মাত্রিক উপস্থাপনা চোখে পড়েছে শুধু। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীর্তিÑ বাংলাদেশ। শোষিত বঞ্চিত বাঙালীকে একটি সার্বভৌম ভূখ- উপহার দিয়ে ইতিহাসের মহানায়ক হয়েছিলেন তিনি। অথচ স্বপ্ন দিয়ে গড়া দেশে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে খুন হন স্বপ্ন দেখার সর্বোত্তম পুরুষ। স্বাধীনতা এনে দেয়ার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে। সপরিবারে হত্যা করা হয়। কালো দিবসটিÑ ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। দেশী বিদেশী শত্রুরা ভেবেছিল, শেকড় শুদ্ধ উচ্ছেদ করা গেছে মুজিবকে। আদতে মুজিব মৃত্যুঞ্জয়। মুজিব বাংলাদেশের অপর নাম। এই নাম কী করে মুছে যাবে? আজকের বাংলাদেশ তাই মুজিবের মানচিত্র। বরাবরের মতো এবারও চির বিদায়ের দিনে শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করা হয়েছে প্রিয় পিতাকে। সাধারণ মানুষের বুকে তিনি ছিলেন। ছিলেন সভা সমাবেশে। ব্যানারে ফেস্টুনে। কথা কবিতায় গানে ফাদার অব দ্য নেশনকে স্মরণ করা হয়েছে। আরও সত্য আরও অনিবার্য হয়ে সারা বাংলায় এদিন ছড়িয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কবির ভাষায়Ñ দীর্ঘ হ’তে-হ’তে/ মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে, আদরে...। সেই আদর ¯েœহের টানে খুব ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন রাজধানীর মানুষ। কৃতজ্ঞ বাঙালীর একটিই গন্তব্যÑ ধানম-ি ৩২। স্রোতের মতো সেদিকে ছুটছিলেন সবাই। অনেক দূরে গাড়ি রেখে পায়ে হাঁটতে হচ্ছিল। অথচ ক্লান্তিহীন। কী এক জাদুমন্ত্র টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বেলা ১২টার পর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির সমানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের নীরব উপস্থিতি। অনেকেই শোকের কালো রঙে সেজে এসেছিলেন। হাতের মুঠোতে ধরা ছিল কাঁচা রজনীগন্ধা। গ্ল্যাডিওলাস। ধীর পায়ে হেঁটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলেন তারা। ছলছল চোখে তাকাচ্ছিলেন ঐতিহাসিক ভবনটির দিকে। শূন্য খোলা বারান্দাটি দেখা যায়। সবুজ পাতা আর সুগন্ধি ফুলেরা এখন এটিকে ঘিরে রেখেছে। ভালবাসায় জড়িয়ে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে। দেখতে দেখতে কখনও ভেতরটা গুমরে কেঁদে ওঠে। কখনও হেসে ওঠে মন। এই ভেবে হেসে ওঠে যে, মুজিবের নামে ঠিক ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ স্বরূপে ফিরেছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালীর প্রতিকৃতির সামনে এখন দীর্ঘ লাইন। সেই লাইলে লম্বা সময় দাঁড়িয়ে ফুল দেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। কয়েকজনের একটি দলের সঙ্গে এসেছিলেন এনায়েত উল্লাহ। স্থানীয় বাসিন্দা। বহু বছর ধরে শুক্রাবাদ এলাকায় বসবাস করছেন। বললেন, ৩২ নম্বরের বাড়িটি খুনীরা তালা দিয়ে রেখেছিল বহু বছর। সামনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বসে পাহারা দিতেন। ভেতরে কাউকে তারা প্রবেশ করতে দিতেন না। দূর থেকে আমরা দেখেছি, গাছপালা বড় হতে হতে জঙ্গলের আকার ধারণ করেছিল। বাড়িটি ভাল দেখা যেত না। এর পরও সাধারণ মানুষ উঁকি দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করতেন। তার পর এক বুক হাহাকার নিয়ে ফিরে যেতেন তারা। আর এখন দেখুন কত মানুষ। মানুষের ঢল নেমেছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিন শহরের প্রতি প্রান্ত থেকে উচ্চারিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। শিল্পকলা একাডেমিতে নানা আয়োজনে স্মরণ করা হয় জাতির জনককে। ‘শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালা চলছিল মাসের প্রথম দিন থেকে। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে বিশেষ চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ২২ জন শিল্পীর আঁকা ছবিতে মূর্ত হয়ে উঠেছেন মহান নেতা। জাতীয় জাদুঘরে আয়োজন করা হয় বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ক্যামেরায় তুলে আনা বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হয় এখানে। নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজের ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় আরেকটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর। এখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যগুলোকে ফ্রেমবন্দী করে উপস্থাপন করা হয়। শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে মাসের প্রথম দিন থেকেই চলছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বাংলা ও ইংরেজী বইয়ের বিশেষ প্রদর্শনী। ‘জাতির জনককে জানুন’ শীর্ষক আয়োজনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত দেড় হাজার বাংলা ও ইংরেজী গ্রন্থ প্রদর্শিত হচ্ছে। আছে জীবনী গ্রন্থ, প্রবন্ধ, কবিতা, তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণসহ নানা রচনা। জাতির জনককে বিষয় করে লেখা বইগুলো দিয়ে সাজানো হয়েছে একটি আলাদা কর্নার। সেখান থেকে পছন্দমতো বই খুঁজে নিয়ে সেখানে বসেই পড়ছিলেন পাঠক। এভাবে জাতির জনকের দারুণ এক ফিরে আসা। বাঙালীর শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে ফিরে এসেছিলেন মুজিব। সব দেখে মন গুন গুন করে গাইছিলÑ ‘একটি মুজিবরের থেকে/লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/আকাশে বাতাসে ওঠে রণী...’।
×