ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীন ও রাশিয়া ॥ বাইরে ভাব ভেতরে দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৬ আগস্ট ২০১৭

চীন ও রাশিয়া ॥ বাইরে ভাব ভেতরে দ্বন্দ্ব

গত জুলাই মাসের শেষ দিকে বাল্টিক সাগরে চীন ও রাশিয়ার নৌবাহিনীর প্রথম মহড়া হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশ দুটি আমেরিকার কাছে একটা বার্তা পাঠায় যে তারা পাশ্চাত্যের আধিপত্য বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ এবং ন্যাটোর পশ্চাদভূমিতে শক্তি প্রদর্শনে পরোয়া করে না। একই সঙ্গে তারা এটাও দেখাতে চায় যে ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত তাদের মধ্যে যে তিক্ত শত্রুতা ছিল তা আর নেই এবং তাদের বন্ধুত্ব আজ অনেক নিবিড়। বন্ধুৃত্বের এই প্রতীকী ঘটনার অভাব নেই। গত মাসে জার্মানিতে জি-২০ এর বৈঠকে যাওয়ার পথে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মস্কোয় যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট পুতিন তাকে রাশিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক অর্ডার অব সেন্ট এন্ড্রু পরিয়ে দেন। ব্যাপারটা এখন এমন যেন চীন ঝুঁকছে রাশিয়ার দিকে আর রাশিয়া ঝুঁকছে চীনের দিকে। ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শি জিনপিং যতবার মস্কো সফরে গেছেন ততবার অন্য কোথাও যাননি। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বৈঠকের সময় তিনি পুতিনের ঘরোয়া জন্মদিন পার্টিতেও যোগ দেন। ২০১৫ সালে মস্কোয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের ৭০তম বার্ষিকী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান পশ্চিমী নেতারা বর্জন করলেও শি জিনপিং সেখানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। চার মাস পর পুতিন বেজিংয়ে জাপানবিরোধী যুদ্ধে চীনের বিজয় বার্ষিকী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দুটি দেশ মনে করছে যে তারা পাশ্চাত্যের তথ্য সন্ত্রাসের শিকার। তাই দুটি দেশকে পাশ্চাত্যের মূল ধারার সাংবাদিকতার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রেসিডেন্ট শি রাশিয়ার প্রধান টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল ওয়ানকে’ চীনে কেবল সার্ভিস চালুর অনুমতি দিয়েছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে পাশ্চাত্যের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে মস্কো বেজিংয়ের দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকেছে। তবে দু’দেশের বন্ধুত্বের এই বাহ্যিক চেহারার আড়ালে মৌলিক পার্থক্যও রয়ে গেছে। চীনের যতটা রাশিয়াকে প্রয়োজন তার চেয়ে রাশিয়ার চীনকে বেশি প্রয়োজন। রাশিয়া এই ভারসাম্যহীন সম্পর্ক নিয়ে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। রাশিয়া তার এই জনবহুল, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী এবং দ্রুত সামরিক শক্তি অর্জনের প্রয়াসে লিপ্ত প্রতিবেশী সম্পর্কে উদ্বিগ্ন বোধ না করে পারে না। অন্যদিকে চীনও স্নায়ুযুদ্ধোত্তর ব্যবস্থাকে রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ করার আগ্রহে উদ্বিগ্ন। কারণ এই বিশ্বায়ন থেকে রাশিয়ার চেয়ে চীন অনেক বেশি লাভবান হয়েছে। এই স্ট্যাটাসকো স্পষ্ট করতে চীনের আগ্রহ কম। ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপের প্রতি চীন দেখেও না দেখার নীতি নিয়েছে। তেমনি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরোধীয় দখলের প্রতিও রাশিয়ার ভূমিকা একই। কিন্তু রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়নি। চীনের জন্য আমেরিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সেই কারণে রাজনৈতিক সম্পর্ক দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। সেই তুলনায় আমেরিকার সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য নগণ্য। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে চীন প্রধানত সেই দেশটির তেল ও গ্যাসের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। ২০১৪ সালে রাশিয়া ও চীন নতুন পাইপলাইন দিয়ে সাইবেরিয়ার দুটো খনি থেকে ৪০ হাজার কোটি ডলার মূল্যের গ্যাস চীনে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডেলিভারি ২০১৯ সালে শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন পাইপলাইনে অর্থায়ন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে মতবিরোধ আছে। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও অন্যান্য ইস্যুতে আপাতদৃষ্টিতে যতই মাখামাখি থাক ভেতরে ভেতরে বিরোধও আছে। চীনের প্রতি ক্রেমলিনের এক ধরনের সুগভীর ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ আছে। এক প্রবীণ রুশ ব্যাঙ্কারের ভাষায়, রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, দেশটি এই সম্পর্ক থেকে কি চায় তা সে নিজেই জানে না। রুশ সরকার চীনের অর্থ চায় কিন্তু চীনাদের নয়। অন্যদিকে রুশ শক্তি সম্পর্কে চীনাদের কোন বিভ্রম নেই। চীনের দৃষ্টিতে রাশিয়া দুর্বল ও শক্তি হ্রাসের পথে। তথাপি পারমাণবিক শক্তিধর এই দুর্বল শক্তিটি তার মাথাব্যথার কারণ হোক এটাও চীন চায় না। রাশিয়াও চীনের ব্যাপারে নার্ভাসবোধ করে। বাল্টিকে চীনের সঙ্গে যৌথ মহগড়া করা সত্ত্বেও রাশিয়া চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের প্রস্তুতি হিসেবে অন্যান্য মহড়াও করে। রাশিয়ার আশঙ্কা, তার এই ঘনবসতির প্রতিবেশী রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের হাল্কা বসতির ভূখ- একদিন দখলে নিতে চাইবে। মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়েও দুই দেশ প্রতিযোগিতা ও প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ওই অঞ্চলে চীনের দৃষ্টি অর্থনীতির ওপর। সে দেশটি সেখানকার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। রাশিয়া সেখানকার প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হতে চায়। কিন্তু তার সেই অর্থনৈতিক শক্তি নেই। এ কারণে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীনকে একটু বাঁকা চোখে দেখে দেশটি। সূত্র : টাইম
×