ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

‘তবু তিনিই কিংবদন্তি’

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৬ আগস্ট ২০১৭

‘তবু তিনিই কিংবদন্তি’

ক্যারিয়ার ছিল রঙিন, ঝলমলে। সেখানে ছিল না কোন আঁধারের লেশমাত্র! বৈচিত্র্যতার বড়ই অভাব ছিল দীর্ঘ ক্যারিয়ারে। কারণ, ট্র্যাকে নামলেই একঘেঁয়ে সাফল্য আর জয়। অবশেষে ক্যারিয়ারের শেষ রেসে হেরে যাওয়াতেই না বৈচিত্র্যময়তা আসলো কিংবদন্তি স্প্রিন্টার উসাইন বোল্টের। এখন গতির রাজ্যে চরম বিস্ময় এ গতিধর মানবের নামের সঙ্গে অসংখ্য জয়ের পাশাপাশি আছে পরাজয়ের অভাবনীয় বিষাদ-গাঁথাও। যার সঙ্গে কোন মানুষের পেরে ওঠা সম্ভব নয় বলেই ঘোষণা করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিংবদন্তী মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী সর্বকালের সবচেয়ে সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্বীকৃত। তিনিও জীবনের শেষ লড়াইয়ে হেরে গিয়েছিলেন। এবার লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসে ১০০ মিটারের সম্রাট বোল্ট হেরে যাওয়ার পর কেউ একজন চিৎকার করে সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে-‘চিন্তা করো না উসাইন, মোহাম্মদ আলীও তার শেষ লড়াইয়ে হেরে গিয়েছিলেন।’ না, কোন আক্ষেপ কিংবা দুঃখবোধ কাজ করেনি জ্যামাইকান গতি বিদ্যুত বোল্টের মনে। বিষাদ আর তিক্ততায় ছেয়ে যায়নি মন। বরং বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমিই সর্বকালের সেরা, কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ!’ সেটা সবাই বিনাপ্রশ্নে, বিনাতর্কে মেনে নিয়েছেন। এমনকি ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ট্রিপল জয়ের পরও যারা তাঁকে কিংবদন্তি মানতে অস্বীকার করেছিলেন তারাই এবার তাঁকে সর্বকালের সেরা এ্যাথলেট এবং কিংবদন্তি স্প্রিন্টার হিসেবে মেনে নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই বিন্দুমাত্র দুঃখবোধ থাকার কোন প্রশ্নই নেই বোল্টের। তবে ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের জগত থেকে অবসর নেয়া হয়ে গেছে, বিদায়ের আগে ভক্ত-সমর্থক আর ট্র্যাকটাকে ছেড়ে যাওয়াটাকে এক বিরহ-বিচ্ছেদ হিসেবে হৃদয়ে খোঁচাখুঁচি করেছে। আর সে কারণেই বলেছেন, ‘ছেড়ে যেতে খুবই দুঃখবোধ করছি।’ ১০ বছর বয়স থেকে ট্র্যাকের সঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটা মাত্র ৩০ বছর বয়সেই সমাপ্ত। হয়তো অনেক বয়স এখনও পড়ে ছিল। অবসর ভেঙ্গে অনেকেই ফিরে আসেন। কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এ সর্বকালের সবচেয়ে গতিধর মানব জানিয়েছেন সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। ক্যারিয়ারের শেষ দুটি রেসেই পরাজয়। অভাবনীয় এক সমাপ্তি। স্প্রিন্ট জগতের কিংবদন্তি ক্যারিয়ারের মাঝপথেই হয়ে গিয়েছিলেন। অপরাজেয় বোল্টকেও থামতে হয়েছে। এবার লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসে সবকিছু যেন ল-ভ- হয়ে গেল। জ্যামাইকার গতি ‘বিদ্যুৎ’ উসাইন বোল্ট হারতে জানেন, কারণ তিনি রক্তমাংসের মানুষ। তবু তার চরম প্রতিপক্ষরাও তাঁকে হারানো অসম্ভব বলেই মেনে নিয়ে কুর্ণিশ করেন গতির সম্রাট হিসেবে। তার বিকল্প পাওয়াটা একেবারেই দুষ্কর। সেক্ষেত্রে একজন ‘সুপার হিউম্যান বা অতিমানব’ কাউকে আসতে হবে স্প্রিন্ট জগতে। এমনটাই বলছেন সবাই। তবে এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের জগতে আর রেসের জন্য নামবেন না সেটা নিয়েই নিজের চরম দুঃখবোধ প্রকাশ করলেন তিনি সংবাদ সম্মেলনে। কিন্তু আর অবসর ভেঙ্গে ফিরে এসে নিজের লজ্জা বাড়াতে চান না বোল্ট। জানিয়েছেন এখন জীবন উপভোগ করতে চান। এবার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সবাইকে হতবিহ্বল করে দিয়ে হেরে যান বোল্ট। অথচ ২০০৯ সালে এই ইভেন্টেই ৯.৫৮ সেকেন্ড টাইমিং গড়ে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেন। অথচ প্রাণীবিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছিলেন কোন মানুষের পক্ষে ৯.৭০ সেকেন্ডের নিচে টাইমিং গড়া অসম্ভব। সেই গবেষণাকে ভুল প্রমাণ করেছিলেন, হয়ে গিয়েছিলেন অতিমানবীয় কিছু। কিন্তু দলগত ৪ ী ১০০ মিটার রিলেতেও হার দেখতে হয়েছে। ঊরুর পেশিতে টান পড়ার কারণে মাঝপথেই ট্র্যাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। আর উঠতেই পারেননি। জ্যামাইকার দলটি কোন পদকই পায়নি রেস শেষ না হওয়াতে। কিন্তু হারলেও বোল্ট কিংবদন্তি হয়েছেন বহু আগেই। টানা তিন অলিম্পিকে স্প্রিন্টের ডাবল জেতা এই এ্যাথলেট তো ‘অমরত্ব’ই পেয়ে গেছেন। তাঁর মতো ট্র্যাকে ঝড় তুলতে পারেনি কেউ। কেউ কখনও করতে পারবেন এমনটাও বিশ্বাস করতে পারেন না প্রাণী গবেষকরা। ক্যারিয়ারজুড়ে ট্র্যাকে গড়ে ঘণ্টায় ২৩ মাইল গতিতে ছুটেছেন। সর্বোচ্চ ২৭ মাইল গতিতেও ছুটেছেন তিনি। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টারে ১৫০ মিটারের এক রেস শেষ করেছিলেন ১৪.৩৫ সেকেন্ডে। সেদিন তাঁর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫.৭১ মাইল (৪১.৩৮ কিলোমিটার)। এ গতিতে তিনি ১০০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ডের দিনেও ছোটেননি। অবশ্য দর্শকদের আনন্দ দিতে বুক চাপড়ানো কিংবা আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে দৌড় শেষ না করলে ১০০ ও ২০০ মিটারের রেকর্ডগুলো চাইলেই আরও ভাল করতে পারতেন। প্রাণীজগতের অনেক গতিধর জীবই দৌড়ে বোল্টের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এর মধ্যে টেরিয়ার জাতে কুকুর সবচেয়ে গতিধর হলেও বোল্টের চেয়ে কম গতিসম্পন্ন। এতকিছু গবেষণার ফলাফল বলছে বোল্টের শূন্য করে রেখে যাওয়া জায়গাটি অপূরণীয়। সেক্ষেত্রে আরেক অতিমানব আসতে হবে স্প্রিন্ট জগতে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন তরুণকে বোল্টের যোগ্য উত্তরসূরি মনে করা হলেও তারা কেউ বিস্ময়কর কোন টাইমিং দেখাতে পারেননি। নিজের বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে বোল্ট বললেন, ‘কঠিন কয়েকটা দিন গেছে। আমি সবসময় শতভাগ দিয়ে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করি। প্রচেষ্টা থাকে ভাল প্রদর্শনী দেখানোর। কিন্তু এখন আমি খুবই দুঃখ পাচ্ছি চলে যেতে হচ্ছে বলে। খুবই আবেগী মুহূর্ত আমার জন্য। আমার মনে হয় না একটা চ্যাম্পিয়নশিপস আমি যা করেছি এই ক্রীড়াতে সেই অর্জনে কোন পরিবর্তন আনতে পারবে। আমি ১০০ মিটারে হারের পর মনে পড়ছে কেউ একজন বলছিলেন- উসাইন চিন্তা করো না, মোহাম্মদ আলীও তার ক্যারিয়ারের শেষ লড়াইয়ে হেরেছিলেন। আমি নিজেকে বছরের পর বছর প্রমাণ করেছি।’ আর কখনও ফিরে আসবেন না বলেই জানিয়েছেন ৩০ বছর বয়সী বোল্ট। তিনি বলেন, ‘না, এটা সম্ভব নয়। আমি অনেক মানুষকে দেখি তারা ফিরে আসে ক্রীড়ায় এবং নিজেদের লজ্জাটা বাড়িয়ে ফেলে। আমি তাদের একজনও হতে চাইনা। আমি এখন মুক্ত অবস্থায় থাকতে চাই। আমি খুব সুখী থাকব। কারণ ১০ বছর বয়স থেকেই আমার জীবন বলতে ছিল ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ড। যা কিছুই জানতাম সেটা ছিল ট্র্যাক সম্পর্কিত। এখন আমার মজা, আনন্দ দরকার এবং কিছুটা অবসরে থাকা প্রয়োজন। এখন সেটাই করতে চাই।’ ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে ট্রিপল স্বর্ণপদক জিতে সবাইকে চমকে দেন বোল্ট। পরের বছরই বার্লিনে ১০০ মিটারে ৯.৫৮ সেকেন্ড টাইমিং নিয়ে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করে হতবিহ্বল করে দেন সমগ্র বিশ্বকে। সেই বোল্ট ট্রিপলের ডাবল করেন ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে, গত বছর রিও অলিম্পিকে ম্যাজিক ফিগার ট্রিপল-ট্রিপল গড়েন সর্বকালের সবচেয়ে গতিধর এ মানব। কিন্তু বিশ্ব আসর দিয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানতে গিয়ে এ ৩০ বছর বয়সী তারকার সঙ্গী হলো বিষাদ-ব্যথা। হারানোর হতাশা। ২০০ মিটারে আগেই নাম প্রত্যাহার করেছিলেন, কিন্তু ১০০ মিটারে চরম প্রতিপক্ষ গ্যাটলিনের কাছে হেরে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। এবার দলগত ইভেন্টেও পারলেন না। কিন্তু এ বিষয়ে বোল্টের পূর্বসূরি স্প্রিন্ট সুপারস্টার মাইকেল জনসন বলেন, ‘এখনও বলব বিশ্বে এমন কোন এ্যাথলেট নেই যার পক্ষে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়া সম্ভব। তিনি সারাবিশ্বের সুপারস্টার।’ জনসনের ২০০ মিটারে গড়া বিশ্বরেকর্ড ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বোল্ট। তার বিষয়ে সাবেক আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি প্রেসিডেন্ট জ্যাকুয়েস রগ বলেন, ‘তিনি একজন আইকন। সর্বকালের সবচেয়ে সেরা স্প্রিন্টার তিনি।’ অবশ্য ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকেই তিনি বোল্টকে কিংবদন্তি মানতে রাজি হননি।
×