ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চিকিৎসা ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ১৬ আগস্ট ২০১৭

চিকিৎসা ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত হয়ে যায়

মহিলার নাম ইয়াসমারী দিয়াজ। বাড়ি ভেনিজুয়েলার গুয়ারেনাস-এ। একদিন সে তার তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে একটি পিকআপ ট্রাকের পেছনে উঠে পড়ল। গন্তব্য বেশি দূরের নয়। তবে পথটা এত উঁচু-নিচু আর এবড়ো-খেবড়ো যে, সামান্য দূরত্ব পাড়ি দিতেই শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে যাওয়ার যোগাড়। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছাল দিয়াজ। জামোরায় পাহাড়ের পাদদেশে এক ছোট জীর্ণ কুটির। মাটি ও গাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি। দিয়াজের স্তন ক্যান্সার হয়েছে। চিকিৎসার আর কোন পথ না পেয়ে এই অভিশপ্ত ব্যাধির ছোবল থেকে মুক্তিলাভের জন্য মরিয়া হয়ে সে এসেছে জাদু টোনার চিকিৎসা নিতে। ওখানে একজন বদ্যি আছে। এমিরেগিলডো নামে কয়েক দশক আগে মারা যাওয়া এক বর্ষীয়ান ব্যক্তির শক্তিশালী আত্মাকে নিয়ে এসে সেই বদ্যি নানা রোগের চিকিৎসা করে। বদ্যির নাম এডুয়ার্ড গুইডিস। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে বলে শামান। প্রথা অনুযায়ী দিয়াজ মাটির মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তার চারদিকে জ্বলছে মোমবাতি। সাদা রঙের চক দিয়ে বিচিত্র প্যাটার্নের সব আঁকিবুকি। দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে দিয়াজ। সিগারের ধোঁয়ার মেঘের মধ্যে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে গুইডিস। বুক খোলা শরীরে ঝুলছে রঙ-বেরঙের পুঁতির মালা। বুনো শুয়োরের দাঁতের মালাও শোভা পাচ্ছে সেখানে। জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করতে থাকে গুইডিস। ডাকতে থাকে তাদের ধর্মীয় গোত্রের আত্মাদের যাদের একজন এসে দিয়াজের ওপর ভর করে তার রোগ সারিয়ে দেয়। গুইডিস এরপর হাঁটু গেড়ে বসে। দাড়ি কাটার ব্লেড দিয়ে দিয়াজের স্তনের গায়ে কয়েকটা আঁচড় কাটে। অতঃপর লাল গোলাপ ফুল দিয়ে স্তন ঢেকে দেয়। দিয়াজের বুকের কয়েক ইঞ্চি উপরে মুখটাকে নামিয়ে এনে সে সিগারে টান দেয় এবং তারপর পালাক্রমে একবার টিউমারের ওপরের চামড়ার গায়ে ধোঁয়া ছাড়ে এবং পরের বার মোমবাতি থেকে গলিত মোম ফোটায় ফোটায় ঢেলে দেয়। ওদের বিশ্বাস তামাকের ধোঁয়া রোগব্যাধি শুষে নেয়। সিগারের ছাইয়ের রং কালো থেকে সাদায় রূপান্তরিত হলে বুঝতে হবে রোগ সেরে যাচ্ছে। ভেনিজুয়েলার হাজার হাজার নর-নারী আজ চিকিৎসার জন্য জাদুটোনার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদেরই একজন ২৮ বছর বয়স্ক দিয়াজ। কেন এমন হচ্ছে? কারণ ভেনিজুয়েলার স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা এখন মহাসঙ্কটে। এই ব্যবস্থা জনগণের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ইউগো শ্যাভেজ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে সম্পদের বিশাল অপচয় ঘটিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করে থাকে তার বিরোধী শিবির। সেই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে যে বিশাল ধস নেমে এসেছে তারই অংশ হলো স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার এই সঙ্কট। ভেনিজুয়েলার ওষুধ শিল্প ফেডারেশন জানিয়েছে যে, অত্যাবশ্যক ৮৫ শতাংশ ওষুধ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বা কঠিন। ওষুধের দোকানের তাকগুলো খালি। সরকারী হাসপাতালগুলো ওষুধের অভাবে রোগীদের ফিরিয়ে দেয়। সিলভিয়া লিমার্ডোর ওষুধের দোকানটি আগে ক্যারাকাসের শ্রেষ্ঠ ওষুধের দোকান বলে পরিচিত ছিল। সব ধরনের ওষুধের এখানকার মতো এত ভাল মজুদ খুব কম দোকানেই ছিল। আজ সেই দোকানের শূন্য তাকগুলোই বলে দেয় পরিস্থিতি কতটা শোচনীয়। এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যথা, বেদনা, এলার্জি, মৃগী ও উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খুঁজে পাওয়া আজ ভাগ্যের ব্যাপার। সরকার স্বাস্থ্য পরিচর্যার বর্তমান পরিসংখ্যানগত চিত্র প্রকাশ করছে না। তবে ৯২টি রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতালের ওপর এক জরিপ রিপোর্ট গত মার্চ মাসে প্রকাশ করেছে ‘ফিজিশিয়ানস ফর হেলথ’ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা যায়, ৭৮টি হাসপাতালই বলেছে তাদের কাছে ওষুধ নেই কিংবা ওষুধের মারাত্মক ঘাটতি আছে। ৮৯টি হাসপাতালে নিয়মিত এক্স-রে করা সম্ভব হয় না এবং ৯৭ শতাংশ মেডিক্যাল ল্যাব পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করতে পারছে না। দিয়াজ চিকিৎসার জন্য এক বছর অপেক্ষা করে কাটিয়েছে। তার হাসপাতালের ডাক্তাররা বার বার তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মেমোগ্রাফি মেশিন এখনও ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে। ওষুধের যেমন কোন মজুদ নেই তেমনি নেই তাঁর রক্ত পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক। কিংবা এক্স-রে ডেভেলপ করার উপায়। দিয়াজের কোন বীমা সুবিধা নেই। সে অন্যের বাড়িঘর পরিষ্কার করে, রুটি বানিয়ে যৎসামান্য যেটুকু আয় করে তা দিয়ে ব্যয়বহুল প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করা দিয়াজের পক্ষে সম্ভব নয়। গত বছরের নবেম্বরে দিয়াজের মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এ বছরের জানুয়ারিতে দিয়াজের বৃহত্তর পরিবারের এক মহিলা ক্যান্সারে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার পর সরকারের শিশু রক্ষা সার্ভিস তার এক বছরের শিশুকে নিয়ে গেছে। দিয়াজ এই আশঙ্কায় তাড়িত যে, তারও ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটলে একই পরিণতি তার বাচ্চাদের বেলায়ও হবে। তাই জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে সে ঝুঁকেছে জাদুটোনার চিকিৎসায়। দিয়াজ বলে, আগে আমি কখনও এসবে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সেদিন আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক করলাম এসবে ভয় আমার লাগে ঠিকই। তথাপি এই চিকিৎসা আমি নেব। দেখা যাক কি হয়। নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা সেখানে যায়। কারও হার্টের সমস্যা, কারোর মেরুদ-ের, কারোর ক্যান্সার, কারোর পা, হাঁটু বা চোখের সমস্যা, এদের সবাই গরিব। প্রথম দফা চিকিৎসা নেয়ার কয়েক সপ্তাহ পর দিয়াজ জানায় তাঁর স্তনের ব্যথা কমেছে। সে এখন আরও বেশি এনার্জি পাচ্ছে। সুইডিশ তাকে জানিয়েছে তার আরও দুটো সেশন লাগবে। দিয়াজের এখন এতে বিশ্বাস এসেছে। এই চিকিৎসা সে নেবেই। দিয়াজ বলেন, এই কুটিরের দরজায় কড়া নাড়লে সাহায্য মিলবে যা কারোর চোখে ধরা পড়বে না। এ অনেকটা বায়ুর মতো। দেখা যায় না তবে অনুভব করা যায়। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×