ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল

পরবর্তী করণীয় ও সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিকে জানালেন কাদের

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৫ আগস্ট ২০১৭

পরবর্তী করণীয় ও সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতিকে জানালেন কাদের

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে দেয়া পর্যবেক্ষণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকের একদিন পর সোমবার রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠকে রায় নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। একই সঙ্গে রায়ের পর্যবেক্ষণে অপ্রাসঙ্গিক ও অগ্রহণযোগ্য কিছু বক্তব্য প্রত্যাহার করতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর বক্তব্যে, রায় নিয়ে সরকারের পরবর্তী করণীয় ও সিদ্ধান্তগুলোও রাষ্ট্রপতির সামনে তুলে ধরেছেন ওবায়দুল কাদের। সোমবার বেলা ১২টা ২০ থেকে এক ঘণ্টা বঙ্গভবনে অবস্থান করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পার্টির অবস্থানের কথা রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেছি। রায় নিয়ে আমাদের দলের প্রকৃত অবস্থান কী সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছি। যেহেতু রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক, প্রধান বিচারপতি তিনিই নিয়োগ দেন। তাঁকে আমি বিষয়টি জানিয়েছি। এছাড়া প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে সে বিষয়েও রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের এই সাক্ষাতে কিশোরগঞ্জে তাঁর এলাকার রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন বিষয়েও খোঁজখবর নিয়েছেন বলে জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গভবনে গিয়ে ওবায়দুল কাদের যখন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান, তার কিছু সময় আগেই বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির দেয়া শুভেচ্ছা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ওই অনুষ্ঠান শেষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধান বিচারপতির কোন কথা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বঙ্গভবনে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাঁর (প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। বঙ্গভবনে যে অনুষ্ঠান আছে সেটা আমার জানা ছিল না।’ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। শেষ হওয়ার আগে কোন মন্তব্য করা যাবে না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আর কোন কোন বিষয়ে কথা হয়েছে জানতে চাইয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব সময় তাঁর এলাকায় সড়ক পথে যেতে পারেন না। এ বিষয়ে সব সময় তিনি দুঃখ করে কথা বলেন। আমরা উনার এলাকার রাস্তা তৈরির কাজ করছি সে বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়টি সামনে চলে আসে।’ বঙ্গভবনে প্রধান বিচারপতির আসা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, প্রতি বছরই জন্মাষ্টমীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তারই অংশ হিসেবে সোমবার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রায় দেড় হাজার মানুষ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এদের মধ্যে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রথমে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশ করে সুপ্রীমকোর্ট। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তাতে ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটাক্ষ ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে রায়ে সংক্ষুব্ধ সরকারী দল কড়া সমালোচনা করছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর্যবেক্ষণের ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ’ (বাদ) দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার কথা বললেও কীভাবে তা করা হবে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানান। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে এখন অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল দুটি সমর্থিত আইনজীবীরা রায়ের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী পালন করছে। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সরকারী বাসভবনে নৈশভোজে অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বৈঠকে তিনি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে চলমান বিতর্কের ব্যাপারে দলের অবস্থা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতির সামনে। এ সময় তিনি চলমান বিতর্কের অবসান ঘটাতে প্রধান বিচারপতিকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানান বলে জানা গেছে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু জানাতে রবিবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও বৈঠকের সম্ভাবনার কথাও জানান সেতুমন্ত্রী। তিনি বলেন, আলোচনা এখনও শেষ হয়নি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও আলোচনা হতে পারে। সব আলোচনা শেষেই পরিষ্কারভাবে সবকিছু বলা যাবে, তার আগে নয়। এদিকে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বৈঠক নিয়েও রাজনীতি থেমে নেই। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই ওবায়দুল কাদের তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তা অস্বীকার করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের সমালোচনার জবাবে সোমবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘আমাদের সাধারণ সম্পাদকের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করা নিয়ে অনেকে রাজনীতি করছেন, নানা কথা বলছেন, বিতর্ক করছেন। এ নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই। যখন যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে, তখন তো কোন কথা বলেন না। রায়ে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস একটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি ও বিতর্ক দ্রুত নিরসনে ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন। অন্য কিছু নয়। সোমবার রাজধানীর পলাশী মোড়ে সনাতন ধর্মালম্বীদের জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়েও কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে চলমান বিতর্কের ব্যাপারে দলের অবস্থান জানাতে প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েছিলেন। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উদ্বেগ থাকতে পারে, কিন্তু শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই, আমি দেখিনিই। এ ক্ষণিকের মেঘ কেটে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আমি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেছি, আমাদের দলের সভাপতি শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে। প্রধান বিচারপতিকে আমাদের দলের অবস্থান জানিয়েছি। আমি আবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতিকেও সেই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে যে বক্তব্য জানিয়েছি, সেটা রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছি। এই নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আকাশের মেঘ ক্ষণিকের, সূর্য চিরদিনের। ক্ষণিকের মেঘ কেটে যাবে, চির দিবসের সূর্য উঠবে আবার।
×