ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বহু জেলার সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন;###;হুমকিতে তিস্তা ব্যারাজ

বন্যায় ভাসছে উত্তরাঞ্চল ফুঁসছে পদ্মা যমুনা তিস্তা ধরলা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৫ আগস্ট ২০১৭

বন্যায় ভাসছে উত্তরাঞ্চল ফুঁসছে পদ্মা যমুনা তিস্তা ধরলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে গোটা উত্তরাঞ্চল। যমুনাসহ প্রধান নদ-নদীর পানি যেন ফুঁসে উঠছে। নদ-নদীর পানি পাড় উপচে আশপাশের এলাকায় প্রবেশ করছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসেবেই দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলা এখন বন্যায় কবলিত হয়ে পড়েছে। আরও ১০ জেলায় বন্যার বিস্তার লাভ করার আশঙ্কা করা হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আগামী তিন দিন এসব নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। ফলে এই সময়ে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-ধরলা-তিস্তার পানি ফুঁসে উঠছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ ২০ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদ সীমার সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ। সুনামগঞ্জে দ্বিতীবারের মতো বন্যার কবলে ৬ লাখ মনুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার কবলে পড়ে বানভাসী মানুষেরা সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট। বন্যার হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন তারা। বন্যার কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি ওঠার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান সারাদেশে ৩৩ জেলায় বন্যা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বন্যায় এ পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান উত্তর এবং উত্তপূর্বাঞ্চলের ২০ জেলায় ৩৫৬ উপজেলার ৩৫৮ ইউনিয়ন বন্যা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৬ লাখ মানুষ। প্লাবিত উপজেলার ৯৭৪ আশ্রয় কেন্দ্রে ৬৮ হাজার ৫৮৬ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তিনি জানান, রাজধানী ঢাকাও বন্যা কবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ বলছেন, দেশের উজানে তিনটি অববাহিকায় (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) গত দুই-তিন দিন ধরে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হচ্ছে। ফলে এসব অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশের নদীগুলোতে পানি বাড়ছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনকে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে অধিদফতর থেকে। পানি বৃদ্ধির হার অন্তত আরও ৪৮ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদ-নদীগুলোয় পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠাটির নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নদ-নদীগুলোর ৯০ পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের ৬৯টিতে পানি বাড়ছে। এর মধ্যে ২৭ পয়েন্টে পানি বিপদ সীমার ওপরে বয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা-কুশিয়ারায় সমান তালে পানি বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ধরলা, তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধলেশ্বরী, গুর, ধলেশ্বরী, ইছামতি-যমুনা, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, যদুকাটা, সোমেশ্বরী ও কংস নদের পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে সোমবার বিকেল ৩টায় পানির উচ্চতা ছিল বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার উপরে। এই পয়েন্টে এর আগে বিপদসীমার এত উপরে পানি উঠতে দেখা যায়নি। গত বছর বন্যায় এই পয়েন্টে বিপদসীমার ১২১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঠেছিল উল্লেখ করেন। তিনি জানান যমুন নদীর পানি কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ ও সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদী বিপদসীমার ৯৬-১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মাও বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। এই পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনেশ্বরী বদরগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার এবং কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। আগামী কয়েকদিনে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যার বিস্তার বাড়বে বলে আভাস দেন তিনি। আবহাওয়বিদ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন দেশের ভেতরে এবং বাইরে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে পানি সরাসরি দেশে নদ নদীগুলোতে চলে আসছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হচ্ছে। তারা জানা বিগত কয়েকদিন ধরে মৌসুমি বায়ুর আধিক্যের কারণে দেশের ভেতরের ভারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় আজ মঙ্গলবারও আবহাওয়া অধিদফতর ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতে আভাস দিয়েছে। আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে আজ মঙ্গলবারও সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি (৪৪-৮৮ মি:মি:) থেকে অতি ভারি (৮৯ মি:মি: বা অধিক) বর্ষণ হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ী এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আবহাওয়া অধিদফতরের সোমবারের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে হালকা থেকে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এ কারণে রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে। আবহাওয়াবিদ মোঃ শাহীনুল ইসলাম জানান বর্তমানে সারাদেশে অব্যাহত থাকা ভারি বৃষ্টিপাত বৃহস্পতিবার কমতে পারে বলে জানিয়েছেন। তিনি জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে টাঙ্গাইলে ৮৫ মিলিমিটার। জনকণ্ঠের প্রতিনিধিরা জনান, বন্যার কারণে সুনামগঞ্জে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাজশাহীতে শিবনদের বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ১২২টি বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সৈয়দপুরে বানভাসীর খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে পড়েছেন। জালামপুরে নতুন করে ২ লাখ লোক বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। নীলফামারীতে বহুগ্রাম তলিয়ে গেছে। বন্যায় দুই শিশুসহ ৪ জন নিহত হয়েছেন। যমুনায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণে ৩০ হাজার পরিবার দুর্ভোগে পড়েছে। রংপুরে বন্যার তোড়ে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ এবং ফসলি জমি নিমজ্জিত। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠদান হুমকির মুখে। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে আরও সেনাসদস্য এদিকে আইএসপিআর জানায়, স্থানীয় প্রশাসনের অনুরোধে গাইবান্ধা সদরের ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ পুনর্নির্মাণে সেনাবাহিনীর ৩ প্লাটুন সদস্য ৫টি স্পীডবোট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উদ্ধার সামগ্রীসহ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও ১৯ পদাতিক ডিভিশন হতে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষক দল সোমবার সকালে সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যাদুর্গত এলাকা কাজীপুর উপজেলার বাহুকায় গমন করে এবং দুর্গত এলাকা পর্যবেক্ষণ করে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বেসামরিক প্রশাসনের অনুরোধে যে কোন সময় সেনাবাহিনীর আরও সদস্য বন্যাদুর্গত এলাকায় দ্রুততম সময়ে বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার ও বাঁধ রক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়া, সেনাবাহিনী সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে। সুনামগঞ্জ ॥ ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে জেলার ৮টি উপজেলার ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। বন্যায় পানিবন্দী মানুষের কাছে এখনও পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছেনি। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সোমবার থেকে সুরমা নদীর পানি বেড়ে পৌর এলাকার ষোলঘর, কাজীর পয়েন্ট, পশ্চিমবাজার, তেঘরিয়া, সাহেববাড়ির ঘাট, বড়পাড়া, মল্লিকপুর, ওয়েজখালী, জলিলপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সোমবার বেলা ১২টায় সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাত কম হলেও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যার কারণে গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। বন্যায় বেসরকারী হিসেবে ভেসে গেছে ৫ শতাধিক পুকুরের মাছ। এছাড়া ৪ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ও ১৫ হেক্টর সবজি নষ্ট হয়ে গেছে এতে ১২ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। কুড়িগ্রাম ॥ জেলায় বন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমোর নদীর পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোমবার সকালে ধরলা নদীতে ১শ’ ৩২ সেমি. এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৬৮ সেমি. ও দুধকুমোর নদীর পানি বিপদ সীমার ৩ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামে পানিতে ডুবে আরও ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে চলতি বন্যায় জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১২ জনে। সোমবার সকালে টকরাইহাট গ্রামের বড়কুলের পার এলাকায় রেল ব্রিজের গার্ডার ধসে পড়ছে। এতে অনির্দিষ্টিকালের জন্য সারাদেশের সঙ্গে রেলচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে সড়ক ছিঁড়ে যাওয়ায় এবং এর ওপর পানি ওঠায় জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। উলিপুরের বজরা ব্রিজ ভেঙ্গে যাওয়ায় চিলমারী শহরে পানি ঢুকছে। ধরলার প্রবল স্রোতে মোগলবাসা ইউনিয়নের নয়ারহাট এলাকায় একটি ব্রিজ হেলে পড়েছে। ৯ উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দিনাজপুর ॥ বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রবিবার ও সোমবার ৫ শিশুসহ মারা গেছে ১৬ জন। দিনাজপুরের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুটি প্রধান নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সেনা বাহিনীর ৩টি দল উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর পানি কিছুটা কমার তথ্য দিয়েছেন। পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বন্যায় মৎস্যজীবীদের প্রায় দেড়শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সোমবার দিনাজপুরে ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টি সদর, বিরল, বোচাগঞ্জ, কাহারোল, বীরগঞ্জ, খানসামা, চিরিরবন্দর, হাকিমপুর ও ফুলবাড়ী উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার ও আত্রাই নদীর পানি ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাট ॥ অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১১০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ও ধরলা নদী বন্যায় লালমনিরহাট জেলার ৫টি উপজেলার ৩৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার ১ লাখ ৭৫০টি পরিবার বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত লোকজন আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজের বারান্দায়, বাঁধে ও উচু স্থানে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠার কারণে বন্ধ রয়েছে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে রেলপথ ও সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় এবং ভাঙ্গনের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে লালমনিরহাট-বুড়িমারী সড়ক ও রেল যোগাযোগ। নীলফামারী ॥ টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে নীলফামারী জেলার ছয় উপজেলার ৬০ ইউনিয়ন ও চার পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। সরকারী ও বেসরকারীভাবে ত্রাণ বিতরণ এবং সরকারীভাবে সকল সেবা বানভাসিদের দেয়া হলেও থই থই পানির কবলে ২০ লাখ জেলাবাসী চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। চারদিকে এত বানের পানি যে সোমবার বৃষ্টি না হলেও সেই পানি সহজে নামছে না। জলার বিভিন্ন ইউনিয়নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বানের পানিতে ডুবে শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। জামালপুর ॥ জামালপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি সোমবার সকাল থেকে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। হুহু করে বাড়ছে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে সোমবার বিকেলে তিনটার দিকে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে ইসলামপুর উপজেলা। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, ইসলামপুর উপজেলাসহ জেলার দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলায় ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রাজশাহী ॥ মোহনপুর উপজেলার ভীমনগর নামক স্থানে শিবনদের বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মোহনপুর ছাড়াও জেলার তানোর, ও বাগামারার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে তিন উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ কার্যত পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ক্ষেতের ফসল, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। রবিবার বিকেলের পর বাঁধ ভেঙ্গে গেলেও সোমবার বিকেলে পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ফলে প্রবল স্রোতের তোড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রহিমা খাতুন জানান, ভীমনগর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এ পর্যন্ত ৬৭৯ বিঘা জমির ফসল প্লাবিত হয়ে গেছে। এর মধ্যে রোপা-আমন, রোপা-আঊশ, পটল, করলা, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ বিভিন্ন সবজির খেত রয়েছে। আর কেবল পান বরজই রয়েছে ২ হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে পাঠানো হয়েছে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা। গাইবান্ধা ॥ কয়েক দিনের টানা বর্ষণে হুহু করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সোমবার ৬টা পর্যন্ত তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৭৮ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া এ সময় করতোয়া এবং তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনও বিপদসীমার নিচে রয়েছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের ৩৪ হাজার ৯৫৬টি পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এদিকে শহর রক্ষা বাঁধের খোলাহাটি, চকমামরোজপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ ॥ যমুনা নদীর পানি প্রতি ঘণ্টায় দুই সে.মি. করে বাড়ছে। সোমবার বিকেল তিনটার রেকর্ড অনুযায়ী যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ১০৭ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক দিনের ভারী বর্ষণে যমুনার পানি আবার ও বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জের ৫টি উপজেলার ৪০ ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। বানভাসি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে। নওগাঁ ॥ নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। রবিবার রাতে জেলার মান্দায় আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরের পৃথক তিনটি স্থানে মূল বাঁধ ভেঙ্গে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। বগুড়া অফিস ॥ বগুড়ার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অস্বাভাবিক গতিতে বাড়াতে থাকা যমুনার পানি রবিবার বিকেলে বিপদসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়েছে ৪৫ সেন্টিমিটার। বন্যাকবলিত ৩ উপজেলা সারিয়কান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অপরদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আশ্রয় নেয়া লোকজনের সংখ্যাও বাড়ছে। নেত্রকোনা ॥ জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা এবং পূর্বধলা উপজেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটেছে। তিন উপজেলার শতাধিক গ্রামের অন্তত ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাহাড়ী ঢলের পানিতে কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোনা সড়কের বাহাদুরকান্দা থেকে পাচউড়া পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এবং উড়াদিঘী, নিশ্চিন্তপুর ও তেগুরিয়া এলাকার আরও প্রায় আধা কিলোমিটার ডুবে গেছে। এছাড়াও শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কের শান্তিনগর এলাকাও পানির নিচে রয়েছে। জয়পুরহাট ॥ উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪টি নদীর পানি সোমবার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্লাবিত হয়েছে আরও অন্ততঃ ৩ হাজার হেক্টর রোপা আমন ধানের জমি। ফরিদপুর ॥ গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় বেড়েছে ৪৮ সে.মি। ওই পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বর্তমানে বিপদসীমার ১৩ সে.মি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
×