ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিব-ফোর্ড বৈঠকে যা আলোচনা হয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৫ আগস্ট ২০১৭

মুজিব-ফোর্ড বৈঠকে যা আলোচনা হয়েছিল

মোরসালিন মিজান ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম আমেরিকা সফর। পাইপ টোব্যাকো হাতেই হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে প্রবেশ করলেন সদ্য স্বাধীন দেশের সুদর্শন স্মার্ট প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর. ফোর্ডের সঙ্গে তাঁর পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ছবি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। কিন্তু আলোচনা? দুই নেতার মধ্যে কী কী বিষয়ে কথা হলো? না, বাইরের কারও তা জানা হলো না। দীর্ঘ ৩০ বছর পর ২০০৪ সালের ৫ মে আরও অনেক গোপন নথির সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। তারও ১০ বছর পর জেরাল্ড এফ. ফোর্ড লাইব্রেরি থেকে হাতে লেখা ট্রান্সক্রাইবড কপি সংগ্রহ করেন বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. ফিরোজ মাহমুদ। তার কাছ থেকে অতি সম্প্রতি পাওয়া দুর্লভ অনুলিপি পাঠ ও পর্যালোচনা করে জানা যায় অজানা এবং চমকপ্রদ অনেক তথ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অত্যন্ত উদার ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন জাতির জনক। একাত্তরে ভুল নীতি গ্রহণকারী আমেরিকাসহ সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। একই উদ্দেশ্যে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আশা করছিলেন, আটকে পড়া পাকিস্তানীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়া ও সাবেক পাকিস্তানের সম্পদ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়ে সহায়তা করবে আমেরিকা। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য ঘাটতির প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতেও বৃহৎ দেশটির সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সম্পদ আছে। আছে বিপুল সম্ভাবনা। সবার সহযোগিতা পেলে পাঁচ বছরের মধ্যে স্বনির্ভর হবে বাংলাদেশ। কিন্তু পরাশক্তি আমেরিকার কুটিল কূটনীতির কারণে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি বিপর্যয়। ১৯৭৪ সালে চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। মুজিব হত্যার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হয় একই সঙ্গে। দুই নেতার সংলাপ থেকে পূর্বাপর আরও অনেক ঘটনা সহজে বোঝা সম্ভব হয়। ঐতিহাসিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ১ অক্টোবর বেলা ৩টায়। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম হোসাইন আলী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্রেন্ট স্কউক্রফট। দুই নেতার সংলাপটি এক সপ্তাহ পর ৭ অক্টোবর ট্রান্সক্রাইব করা হয়। জানা যায়, সে সময় প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর. ফোর্ডের সহধর্মিণী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। আলোচনার শুরুতে বঙ্গবন্ধু তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। চিকিৎসার খোঁজখবর দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেন, আমাদের জন্য এটা ছিল একটি আঘাত। আমাদের অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। এরপর চরম ক্ষতিকর কিছু আছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্য অপেক্ষার পালা। আপাতত এভাবেই চলছে। মুজিব মিসেস ফোর্ডের আরোগ্য কামনা করে বলেন, আমি আন্তরিকভাবে আশা করি তিনি বিপদমুক্ত হোন। জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, হ্যাঁ, রোগটি সম্পর্কে নিশ্চিত পূর্বাভাস দেয়া যায় না। তবে ৩০টির মধ্যে মাত্র দুটি সংযোগস্থলে ক্ষতিকর কিছু থাকতে পারে। ব্যক্তিগত আলোচনা এখানেই শেষ হয়। এরপর এই প্রথম একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফোর্ড বলেন, আপনাকে এখানে পেয়ে ভালই হলো। জবাবে মুজিবও নিজের ভাললাগার কথা জানান। বলেন, হ্যাঁ, আমি আমার জনগণ সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে খুশি। প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা সব দেশের জন্য যা কিছু করতে পারি, সেজন্য খুশি। মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে বাংলাদেশের ইতিহাসটি তুলে ধরার প্রয়াস নেন বঙ্গবন্ধু। বলেন, আপনি আমার দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন। এর অবস্থাটিকে ঠিক ১৯৪৫ সালে যুদ্ধোত্তর জার্মানির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের সাহায্য করার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। যুদ্ধের আগে আমরা ভারত দ্বারা বিভক্ত ছিলাম। রাজধানী ছিল পশ্চিমপ্রান্তে। ’৪৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থা তেমন খারাপ ছিল না। পার্লামেন্টে শতকরা সত্তর ভাগ প্রতিনিধিই ছিলেন পশ্চিমাংশের। আমি পার্লামেন্টে ছিলাম, যুদ্ধে অধিকাংশ প্রশাসন ধ্বংস হয়ে গেছে কিংবা তারা ভারতে চলে গেছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত আমরা পশ্চিমাদের শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। প্রত্যেকে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। প্রথমে যুদ্ধের জন্য দুর্ভোগ, এরপর খরার জন্য, তারপর বন্যার জন্য। আপনাদের মতো দেশগুলোর সহায়তার জন্য ধন্যবাদ। কেউ এখন অনাহারে নেই। আমাদের সবকিছুই আমদানি করতে হয়েছে। তবুও আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি, খরা ও বন্যা না আসা পর্যন্ত আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু দেশের সম্পদ সম্ভাবনা ও সঙ্কটগুলো তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের সম্পদ রয়েছে। আমরা বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতাম। আমরা ধান, পাট, গম ও তামাক উৎপাদন করি। আমাদের রয়েছে গ্যাসের বড় বড় মজুদ। ১০ থেকে ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট হবে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ। আমরা সার উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। কিন্তু কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের নিজস্ব গ্যাস ও সার কারখানা নিয়ে আমরা সার রফতানি শুরু করতে পারতাম। মুদ্রানীতিই সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। বোঝাতে চান, আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু ফোর্ড বাংলাদেশের সমস্যা সম্ভাবনা আমলে নেন বলে মনে হয় না। তিনি চলে যান তেলের আলোচনায়। তখন উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতে সমস্যায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ওপেক কান্ট্রিগুলো ছিল মুসলিম প্রধান। বাংলাদেশও মুসলিম প্রধান হওয়ায় হয়ত মুজিবের কাছে তেল প্রসঙ্গ তুলে ধরেন ফোর্ড। বলেন, আমরা ওপেক দেশগুলোকে বলছি যে, যদি তাদের তেলের উচ্চমূল্য থেকে সমস্যা সৃষ্টি হয়, যেমনটা আপনার দেশ এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো ভুগছে, তাহলে তেলের উচ্চমূল্য অর্থনীতিতে একটি ধস আনবে এবং এতে তাদের লাভ হবে না। মুজিব যোগ করেন, তেলের মূল্যের কারণে আমরা ভীষণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছি। সহমত প্রকাশ করে ফোর্ড বলেন, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক দেশগুলোকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, তারা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর প্রধান চাওয়া ছিল জরুরী খাদ্য সহায়তা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাস দেশে কোন খাদ্য উৎপাদিত হয়নি। বিশ্বব্যাংক আগাম আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল, দুর্ভিক্ষ হবে। একই আশঙ্কা থেকে বঙ্গবন্ধু নিজেও তার জনগণের জন্য খাদ্য সংগ্রহের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন। আলোচনার এ পর্যায়ে তিনি প্রসঙ্গটি উঠান। বলেন, আমরা দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছি এবং এইমাত্র শুনলাম যে, একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। আমরা গভীর সঙ্কটে পড়েছি। অনাহার থেকে রক্ষা করতে আমি প্রত্যেক অঞ্চলে লঙ্গরখানা খুলে দিয়েছি। কিন্তু আজ এই ইতিহাস সবার জানা যে, বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ ত্বরান্বিত করা ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকা ছিল। ছিল যে, সেটা ফোর্ডের কথা থেকেও অনুমান করা যায়। দুর্ভিক্ষ দুর্যোগের বিষয়টি মোটামুটি এড়িয়েই যান তিনি। কোন মন্তব্য না করে জানতে চান, বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামে কিছু ধনী তেল উৎপাদনকারী দেশের যোগ দেয়ার ঘটনা ভাল লক্ষণ কিনা? বলেন, এটা তাদের একটা সুযোগ দেবে। মুজিব আবুধাবি ও ইরান কনসোর্টিয়ামে যোগ দিয়েছে এমন তথ্য দিয়ে আগের আলোচনায় ফেরেন। দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমেরিকার সাহায্য চান। এবার জোর দিয়ে বলেন, মিঃ প্রেসিডেন্ট, আমি আসন্ন সঙ্কটের সম্মুখীন। খাদ্যশস্য ও খাদ্য সহায়তা চাই আমার। এ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন ফোর্ড। মোটামুটি আশ্বস্ত করেন বঙ্গবন্ধুকে। বলেন, আপনার জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার টন খাদ্য সহায়তা দিতে পারি। তবে শর্ত যোগ করে দেন তিনি। বলেন, আমাদের খাদ্য পরিস্থিতি বুঝে তারপর দেখব আমরা কি করতে পারি। বলতে বলতেই যেন নিজের অবস্থান থেকে আরও একটু পিছিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। বলেন, আমাদের আশা ছিল ফসল ভাল হবে। বসন্তকালে আমাদের এখানে বৃষ্টি হয়েছে এবং তারপর এলো খরা এবং এরপর বেশ আগেই এলো তুষারপাত। তাই ফসলের অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। তিনি বলেন, আমরা দেখছি আমাদের কি আছে এবং যা আমাদের আছে তা থেকে যথাসাধ্য করব। মুজিব সাহায্য চাইলেও, স্মরণ করিয়ে দেন, বাংলাদেশের সম্পদ আছে। বাঙালী ঘুরে দাঁড়াবে। বলেন, আপনি খুবই দয়ালু। আশা করছি, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণ করতে পারলে পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বনির্ভর হব। আমাদের গ্যাস আছে, তেল পাওয়ারও আশা করছি। আটলান্টিক রিচফিল্ড ও ইউনিয়ন অয়েলের সঙ্গে আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। কালক্রমে, আমরা রফতানি করতে সক্ষম হব। কিন্তু তা তো ভবিষ্যতের বিষয় এবং আমার সঙ্কট আসন্ন। জবাবে দ্রুত সহায়তার কোন আশ্বাস না দিয়ে ফোর্ড প্রশ্ন করেন, আপনি কি আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন? মুজিব বলেন, আমরা বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়েছি। মিঃ ম্যাকনামারা আমাদের স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ সফর করেছেন। অধিকাংশ কারখানা এখন চলছে, কিন্তু পূর্ণোদ্যমে কারখানাগুলো চালাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। সংলাপে বাংলাদেশের পাটের প্রসঙ্গ তুলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তখন পাট রফতানি করে সবচেয়ে বেশি বিদেশী মুদ্রা অর্জিত হচ্ছিল। ফোর্ড জানতে চান, পাটের দাম এখন কেমন? মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে, জানান মুজিব। বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়ে আসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ। এ ইস্যুতে আমেরিকার নীতি যে ভুল ছিল, তা ততদিনে প্রমাণিত হয়েছে। আরও একটু পরিষ্কার করতেই হয়ত মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, জেলে গেছে, কিংবা নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছে। বাঙালীর উদারতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা এগুলো ভুলে যেতে চাই। আমরা ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়েছি। এরপর নিজের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। বলেন, আমরা মনে করি সাবেক পাকিস্তানী সম্পদের কিছু অংশ আমাদের পাওয়া উচিত। এর মধ্যে আমাকে একটি নতুন দেশের দায় নিতে হচ্ছে। ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন, আমি তাকে এ কথা বলে দিয়েছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। আরও একটি বড় সমস্যা জিইয়ে রেখেছিল পাকিস্তান। বাংলাদেশে আটকেপড়া নাগরিকদের তাদের দেশে ফেরত নিতে রাজি হচ্ছিল না। এই সমস্যার ভয়াবহতা তুলে ধরে মুজিব বলেন, ৭ লাখ অবাঙালী আমাদের দেশে রয়েছে। এদের মধ্যে ৪ লাখ বাংলাদেশে থেকে যেতে চায়। এটা ঠিক আছে। কিন্তু যারা ওই দেশে যেতে চায় পাকিস্তান তাদের নেবে না। আমার জনগণের জন্য খাদ্য সংস্থান করতে হবে আমাকে। এদের যতœ নিতে হলে আমি আমার জনগণের যতœ কিভাবে নেব? আমি এসব সমস্যা আপনার কাছে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। আমি প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। বাংলাদেশের এই চাওয়ার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের কী চাওয়া, না, জানা যায় না। পরিষ্কার কিছু বলেন না ফোর্ড। পাশ কাটিয়ে জাতিসংঘে চলে যান। বলেন, আপনাদের স্বাধীনতা লাভ ও জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জনের জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। দুই সপ্তাহ আগে আমি সেখানে ছিলাম। জাতিসংঘ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হওয়ার জন্য আমি উৎসাহিত বোধ করেছি। মার্কিন জনগণ সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের প্রতি অপেক্ষাকৃত উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আমি আশা করছি, আমরা সবাই জাতিসংঘে অপেক্ষাকৃত ভাল কাজ করতে পারি। এটা যদি শুধু একটি বিতর্ক সভা হয়, তাহলে এটা ভাল নয়। কিন্তু একে কার্যকর করার জন্য আমাদের একে কাজে লাগাতে হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের আলোচনায়ই থেকে যান। বরফ গলানোর চেষ্টা করে বলেন, আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু আমরা আপনাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। এ পর্যায়ে সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তুলনামূলক চিত্রটা কেমন, জানতে চান ফোর্ড। জবাবে মুজিব বলেন, পাকিস্তানের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৫০ লাখ। পাকিস্তান আমার দেশের চাইতে বড়। আমি একটি পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার কাজ শুরু করেছি। আমাদের এখন সুনির্দিষ্ট কিছু সমস্যা রয়েছে। আমি জেনে আনন্দিত যে, আপনি আমাদের সমস্যা জানেন। আমি টিকে থাকতে চাই। বাংলাদেশের টিকে থাকার প্রবল ইচ্ছে কিংবা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নকে সামান্যই সম্মান জানান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। হয়ত তাই কিছুক্ষণ আগে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকেও সরে আসেন তিনি। এবার বলেন, ১ লাখ ৫০ হাজার টন (গম) সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ১ লাখ টনের নিশ্চয়তা দৃশ্যত দেয়া হয়েছে এবং কেবল আমাদের সরবরাহের অপেক্ষা। বঙ্গবন্ধু তবুও হাল ছাড়েন না। অন্য সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, আপনি কি ভোজ্যতেল ও তুলার বিষয় বিবেচনা করবেন? আমাদের জনগণ এখন আপনাদের সংস্থাসমূহের বিষয়ে আলোচনা করছেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট বলেন, দেখি কি করতে পারি। সংলাপের শেষ অংশে এসে জেরাল্ড আর. ফোর্ডকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান বঙ্গবন্ধু। জবাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার সেখানে যাচ্ছেন না? শেখ মুজিব বলেন, হ্যাঁ, ৩০ অক্টোবর তিনি আসছেন। কিন্তু আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। এভাবে সংলাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নেতা ছিলেন অত্যন্ত উদার ও আন্তরিক। কিন্তু আমেরিকার যে দোদুল্যমানতা, সংলাপের বিভিন্ন পর্যায়ে তা স্পষ্ট হয়। দীর্ঘকাল আগের সেই স্মৃতি জানতে কথা হয় ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। সংলাপের বিস্তারিত আজ আর মনে নেই তার। যেটুকু মনে আছে সেটুকু থেকে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তখন সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত। অনেক বড় নেতা। পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতেও তাঁর অবস্থান তিনি ধরে রেখেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টও তাঁকে সেভাবেই স্বাগত জানান। শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন। সহায়তা আশা করলেও, সেটা হাত পাতার মতো ছিল না। আত্মসম্মান বজায় রেখে কথা বলেন। তাই বার বার আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, আমাদের সম্পদ আছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াব। আপাতত সহায়তা চাই। বঙ্গবন্ধুর উদারতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একাত্তরের আমেরিকার ভূমিকার কথা বলে ফোর্ডকে বিব্রত করেননি। ফোর্ডও তাদের অবস্থানের পক্ষে কিছু বলতে যাননি। বঙ্গবন্ধু আমেরিকা এমনকি পাকিস্তানের ব্যাপারেও উদার ছিলেন। ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবকে হতাশই করেছিল দুটি দেশ। বৈঠকের মতো বাস্তবেও আমেরিকা সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ায়নি বাংলাদেশের পাশে। নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার দুর্ভিক্ষাবস্থা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু ফোর্ডের দেড় লাখ টন থেকেও সরে এসে তিনি মাত্র ১ লাখ টন খাদ্য সহায়তা দেন তিনি। অন্য দেশগুলোও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে থাকে। ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকট আকার ধারণ করে দুর্ভিক্ষ। ২৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘ বাংলাদেশকে ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদানের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানায়। কিন্তু অন্য অনেক দেশের মতো এগিয়ে আসেনি যুক্তরাষ্ট্রও। এভাবে চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে সদ্য স্বাধীন দেশটি। পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা আদায়, আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ফেরত নেয়ার মতো বিষয়গুলোতেও আমেরিকার কোন সহায়তা পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে ড. ফিরোজ মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মধ্যকার প্রথম সাক্ষাত ও সংলাপ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংলাপের ট্রান্সক্রাইবড কপিটি তাই আমেরিকা থেকে আমি সংগ্রহ করেছিলাম। সেখানে যথারীতি দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী একজন নেতা। তিনি জানতেন দেশ পুনর্গঠনের জন্য আমেরিকার মতো পরাশক্তিকে পাশে রাখতে হবে। এরই অংশ হিসেবে সে দেশে যান। কিন্তু আমেরিকার বরফ কেন গলানো গেল না? জানতে চাইলে ফিরোজ মাহমুদ বলেন, প্রথমত আমেরিকার প্রশাসন পাকিস্তানের পরাজয়কে কিছুটা নিজেদের পরাজয় হিসেবে দেখছিল। দ্বিতীয়ত, তারা বঙ্গবন্ধুর কব্জা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। মুজিব বাম ব্লকে ভিড়তে পারেন এমন আশঙ্কা ছিল তাদের। তাই হোয়াই হাউসে মুজিবকে স্বাগত জানানো হলেও, একাত্তরে নেয়া ভুল পররাষ্ট্র নীতি থেকে সরে আসতে পারেনি আমেরিকা।
×