ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশভাগের সত্তর বছর

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৫ আগস্ট ২০১৭

দেশভাগের সত্তর বছর

দেখতে দেখতে সত্তরটি বছর পার হয়ে গেল। বিশাল ভারতবর্ষের জনগণ একদিনের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সত্তর বছর আগে। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট উপমহাদেশ হলো দ্বিখ-িত। বিভাজনের সেই লগ্নে ভাগ-বাটোয়ারার পক্ষাবলম্বী নেতারা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তারা আশা ও আশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, অবশেষে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে দুই দেশের মানুষ তথা হিন্দু ও মুসলমান। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত উপমহাদেশবাসী দুটি জাতিতে যেন পরিণত হলো। ধর্মীয় বিভাজনের ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল আরও আগে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা। যার পরিণতিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটেছে। ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের যাঁতাকলে পড়ে কত প্রাণ বিসর্জিত হয়েছে। তার ইয়ত্তা মেলে না আজও। দেশ ভাগ উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের অনেকেরই জীবনে নেমে এসেছিল হর্ষ, বিবাদ, যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং ঘরতাড়িত সম্পদহারা। স্বজন হারানোর দেনাও কম নয়। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, গোত্রের নামে সে সময় ভাই হত্যা করেছিল প্রতিবেশী ভাইকে, পুরো পরিবারকেও। কবিগুরু লিখেছিলেন, বিশ শতকের প্রথমার্ধে, ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ কিন্তু কালের পরিক্রমায় সাতচল্লিশে সেই মহামানবেরা রবীন্দ্রনাথের ভারতচর্চাকে দুই টুকরো করার জন্য কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমও না করেছিলেন। অন্নদা শংকর রায় এই বিভাজনকে বিশেষত বাংলা ভাগকে মেনে নিতে পারেননি। ক্ষোভে লিখেছিলেন, ‘তোমরা যে সব বুড়ো খোকা, ভারত ভেঙ্গে ভাগ কর।’ এই ভাগের মাসুল গুনতে হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে। দেশ ভাগের আগে ভারতবর্ষ যখন সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আগুনে জ্বলছিল, লাখ লাখ লোক গৃহহীন, সম্বলহীন হচ্ছিলেন, হাজার হাজার নিরীহ ভারতবাসী সাম্প্রদায়িক দানবের খাদ্যে পরিণত হচ্ছিলেন, তখন মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তান দাবি থেকে একটুও নড়তে সম্মত হননি। কংগ্রেস নেতারা লীগের চাপের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য যখন প্রস্তুত, তখন মহাত্মা গান্ধী দিল্লীর ক্ষমতার লড়াই থেকে দূরে ছিলেন। সত্য, ন্যায় ও অহিংসার আদর্শ সম্বল করে তিনি পূর্ব বাংলা ও বিহারের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃযুদ্ধ বন্ধের জন্য আবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু ততদিনে দিল্লীতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নীলনক্সা তৈরি হয়ে যায়। অপরাধীকে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘ আলোচনায় বিরক্ত হয়ে ঘোষণা করেছিল, কংগ্রেস ও লীগ একমত হোক বা না হোক, ব্রিটিশ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যাবে। লর্ড ওয়াভেল এই ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ত্বরান্বিত করতে ব্যর্থ হওয়ায়, তার স্থলে তারা ইংল্যান্ডের অভিজাতদের কুলতিলক লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায়। লীগ নেতাদের তার প্রস্তাব মতো খ-িত পাকিস্তান গ্রহণে রাজি করাতে তাকে বেশি বেগ পেতে হয়নি। বাকি কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে ভারতবর্ষ ব্যবচ্ছেদের প্রস্তাবের সর্বাপেক্ষা হিমালয় প্রমাণ বাধা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। মাউন্টব্যাটেন তাকে দাঙ্গা দমনের দায়িত্ব দিয়ে দিল্লী থেকে দূরে বাংলায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাবে লীগ ও কংগ্রেস নেতারা রাজি হওয়ার পর গান্ধীর পক্ষে দিল্লীতে আর নতুন করে আলোচনা শুরু সম্ভব ছিল না। তার আধ্যাত্মিক সন্তানরা পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করায় তিনি ব্যথিত হলেও নীরব অভিমানে নিজেকে বিদ্ধ করেন। নেহরু ও প্যাটেল সম্মতিদানের আগে মহাত্মার সঙ্গে পরামর্শ করার দরকার মনে করেননি। সারাদেশে যখন সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বলছিল, গান্ধী তাতে ঘৃতাহুতি দিতে সম্ভবত চাননি। ফলে মাউন্টব্যাটনের প্রস্তাবানুযায়ী ভারত ভাগ হয়ে যায়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট-ভারত স্বাধীনতা আইন প্রণয়ন করে। জিন্নাহ সেøাগান ধরেছিলেন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ আর নেহরু ‘জয়হিন্দ’। বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের দেশ ভারতবর্ষ। স্বাধীনতা লাভের পর পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন নিভে যায়। দাঙ্গা থেমে গেলেও ব্যাপক উদ্বাস্তুর ঢল নামে। বাংলা ও পাঞ্জাব থেকে হিন্দু ও শিখরা বিতাড়িত হয়ে ভারতে যায়। অপরদিকে ভারত থেকেও মুসলমানদের আগমন ঘটে পাকিস্তান ও পূর্ব বঙ্গে। সর্বস্বান্ত হয়ে শরণার্থীরা কোন রকমে প্রাণ নিয়ে দেশত্যাগ করে। শরণার্থীর চাপে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। পাকিস্তানের তেইশ বছরের বাঙালীরা নিষ্পেষিত হতে থাকে। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভাষার দাবিতে প্রাণদানকারী বাঙালীরা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যম বাংলাদেশ গড়ে তোলে। দেশ ভাগের তেইশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষজুড়ে এখন তিনটি দেশ। প-িত নেহরু আধুনিক ভারত গড়ে তুলেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে। কিন্তু সত্তর বছরের মাথায় ভারত আবার সাম্প্রদায়িকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান সামরিক শাসনের কবলে পড়ে সাম্প্রদায়িক, জাতীয় দেশে পরিণত হয়েছে। দেশভাগের সত্তর বছরে ও ভারতবর্ষের মানুষের জীবনে শান্তি, সুখ, স্বস্তি আসেনি। জাতপাত আর ধর্ম এখনও তাড়া করে। এখনও হত্যা চলে ধর্মের নামে। আশা করা হয়েছিল, ভারত আবার জাতিসত্তায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে। কিন্তু সে এখনও দূরঅস্ত। উপমহাদেশজুড়ে অশান্তি, হানাহানি, হিংসা, ধর্মান্ধতা লোপ পাবে এমন প্রত্যাশা উপমহাদেশবাসীর হলেও বাস্তবতায় সেদিকে সামান্য পথও হাঁটছে না।
×