ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান

১৫ আগস্ট ॥ বাঙালিত্বকে পাকিস্তানীকরণের চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৫ আগস্ট ২০১৭

১৫ আগস্ট ॥ বাঙালিত্বকে পাকিস্তানীকরণের চেষ্টা

শোকের মাস আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকা-ের শিকার বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মার প্রতি জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। সেদিনের শাহাদাতবরণকারী সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিছক কোন সাধারণ হত্যাকা- ছিল না। এদিন কেবল জাতির পিতাকে হত্যা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। সেদিন তিনটি হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছিল। এক. বঙ্গবন্ধু, দুই. বাংলাদেশ এবং তিন. বাঙালিত্ব। আমরা অনেক সময় দাবি করি, এ অঞ্চলের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল। আমাদের এ ভূ-খ- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু ইতিহাস ঠিক তেমনটি বলে না। এক সময় আমরা হয়তো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে এসে সেই চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। কেননা সাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতেই ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে যায়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু এবং মুসলমান নামে দুটি ভিন্ন জাতির জন্য দুটি কৃত্রিম রাষ্ট্র তৈরি করা হয়। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক চেতনার বদ্ধমূল ধারণা থেকেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম। আর অন্য সাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গের উপস্থিতির কথা বাদই থাক। দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি পুরোটাই সাম্প্রদায়িকতায় ভরপুর ছিল। তারা ইসলামের নামে বিভিন্ন নির্যাতন ও শোষণে লিপ্ত ছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মানুষকে নিপীড়ন করার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আর একটি রাষ্ট্র ভারত। মোটকথা ইসলামের অপব্যবহার আর ভারতের বিরোধিতা করাই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ। শোষণ আর নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ জাতির পিতার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই অনুমান করেছিলেন, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বাঙালিত্ব চেতনা বিকশিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তখন থেকেই শুরু হয় আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক হই। কিন্তু দেখা গেল, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে কেবল রাষ্ট্রনায়ক অথবা স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হলো তা নয়, ইতিহাসের কলঙ্কময় এ হত্যাকা-ের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশকে ফের পূর্ব পাকিস্তানে রূপান্তর করা হয়। সব ধরনের মৌলবাদী চিন্তা-চেতনার অনুষঙ্গ ফিরে আসে। বাংলাদেশকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানিয়ে উল্টোপথে যাত্রা শুরু হয়। এতে করে আমরা আবার আমাদের বাঙালিত্বকে হারিয়ে ফেলি। বাঙালিত্ব এবং বাঙালিত্বের অনুষঙ্গের ওপর শুরু হয় একের পর এক আক্রমণ। অর্থাৎ বাঙালিত্বের বিপরীতে ধর্মীয় মৌলবাদী চেতনার বিকাশের সব ধরনের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা অকল্পনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় কখনও আসেনি যে, বাঙালীরা ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য তার কাছে ঠিক মতো পৌঁছে ছিল কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অনিশ্চিত এ কারণেই যে, মিলিটারি ব্যুরোক্রেসিসহ যারা গোয়েন্দা সংস্থায় থাকেন, তারা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এক ধরনের বাধার সৃষ্টি করেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধে ১০০ জনের কম বাঙালী সেনাবাহিনীর অফিসার পদে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিল এক হাজার জনের মতো অফিসার। আমি বলব না যে, যারা পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিলেন তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। পাকিস্তানে যারা অবস্থান করছিলেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রশিক্ষণ ছিল অন্য রকমের। যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং ৯ মাসের যুদ্ধের নৃশংসতা দেখেননি। স্বাধীন দেশের শুরুতেই সামরিক এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর কয়েকজন বাঙালী অফিসার, সম্ভবত সাতজন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছিল, যারা বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। যেসব পাকিস্তানী সামরিক অফিসার আত্মসমর্পণ করেছিল, তাদের মধ্যে ওই সাত বাঙালী সামরিক অফিসার ছিল। চাকরি চলে যাওয়ায় না খেয়ে মরতে বসেছে বলে জেনারেল ওসমানী তাদের বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়, তারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করে আত্মসমর্পণ করেছে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এদের আর্মিতে নিয়েছিল কে? এরা তো পুলিশ হওয়ারও উপযুক্ত না।’ বঙ্গবন্ধুর অনুকম্পায় তাদের পুলিশে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এরাই ডিআইজি পর্যন্ত হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার সময় ২৭ জন আওয়ামী লীগ কর্মী জীবন দিয়েছিল, ওই হত্যাকা-ের অর্ডার দিয়েছিল ওই ঘরানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭০ সালে যখন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয় তখনও সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার কথা আসেনি। কেবল ছয় দফা উত্থাপিত হয়। কারণ, বঙ্গবন্ধু মনে করতেন ছয় দফা বাস্তবায়িত হলেই আমরা স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাব। সেই ১৯৭০-এর নির্বাচনেও প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ ছয় দফার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। স্বাধীনতা তো দূরের কথা, ছয় দফার বিরুদ্ধেই ছিল ২৪ শতাংশ মানুষ। এ লোকগুলো কোথায় গেল? এ লোকগুলোর পরাজয়ের গ্লানি এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র, সামরিক এবং বেসামরিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র। ফলে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন এবং সরকারকে অকার্যকর করা, জনপ্রিয়তা হ্রাস করাসহ সব জায়গা থেকে সব ধরনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। আজকে আমেরিকা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী এবং চীন আমাদের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র। মনে রাখতে হবে, আমাদের স্বাধীনতার শেষ মুহূর্তে এসে যখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে ভোটাভুটি হয়, তখন সোভিয়েত বলয়ের মাত্র কয়েকটি রাষ্ট্র আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। জাতিসংঘের অনেক রাষ্ট্র, যাদের আমরা ইসলামী রাষ্ট্র এবং বৃহৎ শক্তি বলি তারা কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। কাজেই সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি কেবল পাকিস্তানের পরাজয়ই ছিল না, ওই সকল বৃহৎ শক্তিরও পরাজয় ছিল। ১৯৭৫ সালে সারাবিশ্বে ভিন্ন অবস্থা বিরাজ করে। সামরিক শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পুঁজিবাদের দেশ আমেরিকা এবং কমিউনিজম দেশ চীন এ বিষয়গুলো এক একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্ব নেতা যেমনÑ ফিদেল কাস্ট্রো, মার্শাল টিটো, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সব ঘটনার সম্মিলিত ফলাফলই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। এর মধ্য দিয়ে পরাজিত শক্তি এবং তাদের দোসরদের আক্রোশ মিটে। আজকে আমরা যাদের বন্ধু রাষ্ট্র বা উন্নয়ন সহযোগী বলি তাদেরও কিন্তু আক্রোশ ছিল। হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যগুলো এবং পরবর্তীকালে তাদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কেবল পাকিস্তানই যে পরাজিত শক্তি তা নয়, অন্যরাও পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। তারা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল এবং যুদ্ধে অংশীদারিত্ব ছিল। এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবির রাজাকারদের ষড়যন্ত্র তো ছিলই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা কি আজীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন? রাজাকার সারাজীবনের জন্য রাজাকার কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা আজীবনের জন্য মুক্তিযোদ্ধা নাও হতে পারেন। ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালেও আমি এত রাজাকার দেখিনি। যা এখন দেখি।’ অর্থাৎ রাজাকারদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তারা আজীবন যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ না করে এবং একপর্যায়ে বলেই ফেলেন মুক্তিযুদ্ধ করাটাই ভুল ছিল। তাহলে তিনি আর মুক্তিযোদ্ধা থাকেন কি করে? এর মানে হচ্ছে, ভুল কাজ করে আপনি আজীবন চলতে পারেন না। আজকাল অনেকে বলেন, জঙ্গী, শিবির, মৌলবাদী সংগঠনের যুদ্ধাংদেহী গ্রুপ এদের অনেকেরই জন্ম সাম্প্রতিককালে। এমন অনেক সংগঠনের জন্ম আবার ’৭৫-এর পরে। তাহলে এদের আমরা কেন রাজাকার বলব? মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার চেতনাগত বিষয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিত্বকে স্বীকার করে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তারা যদি এখন তা অস্বীকার করেন তাহলে তারা আর মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারেন না। যার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করলাম, আবার তারই হত্যাকারীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলি, আবার অব্যাহতভাবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করি তাহলে এর চেয়ে হটকারী এবং অপমানজনক আর কিছু হতে পারে না। তবে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, তাদের রাজনীতি করা নিষিদ্ধ করে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানÑ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ে যার ভূমিকা এখন স্পষ্ট, ক্ষমতায় এসে আবার স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে বৈধতা দেয়। তথাকথিত ইসলামিক দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে। চাপাতি-নির্ভর ইসলামিক জঙ্গী সংগঠন, ’৭১ এর স্বাধীনতাবিরোধীদের আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এদের মাঝে এক ধরনের যোগসূত্র রয়েছে। এরা ওই ছয় দফার বিরোধী ২৪ শতাংশের অংশ। ঠিক এরাই রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং পহেলা বৈশাখের বিরোধিতা করেছিল। এমনকি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেরও বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৮ সালের ৮ আগস্ট পাকিস্তান শাসনতন্ত্র পরিষদের মিটিংয়ে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় কেবল কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পক্ষে মত দিয়েছিল। কাজেই চাপাতি মতবাদের উৎপত্তি বর্তমানের আদলে দেখলে হবে না। তাদের উৎপত্তি ভাষা আন্দোলন থেকেই। যা কিছু আমাদের জন্য ভাল এবং মঙ্গলজনক, তার সবকিছুর বিরোধিতা করতে করতে তারা এত দূর এসেছে। বিষয়গুলো চিন্তা করলে রাজাকারদের সংখ্যা বাড়া নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কোন কারণ নেই। অব্যাহতভাবে এদের দমন করার জন্য আইনী ও পুলিশী ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি দরকার এক ধরনের সামাজিক আন্দোলন। তাদের উৎপত্তি ইতিহাস বলে তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে দাঁড় করাতে হবে। কেবল র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে এ অপশক্তি দূর করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু অনেক দূরদর্শী নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টির উর্বরভূমি। আর পাকিস্তান আমলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে ছিল ভারত বিরোধিতা এবং ইসলামের নামে শাসন ও শোষণের সকল উপকরণ। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরুতেই তিনি কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। যাতে আমরা একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতিতে রূপান্তরিত হই। এখন আমরা অনেক কথাই বলি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা কিন্তু বঙ্গবন্ধুই দিয়ে গেছেন। কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশনে শিক্ষাকে একমুখীকরণসহ অনেক বিষয়ই ছিল। মানবিকতাকে বিকশিত করার সামাজিক শিক্ষা যদি আমরা সন্তানদের দিতে না পারি, তাহলে কোনভাবেই জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা মোকাবেলা করতে পারব না। অপশক্তির সঙ্গে অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। অর্থনৈতিক শক্তি এ গোষ্ঠীর চালিকাশক্তি হিসেবে ইন্ধন জোগায়। রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী যাই বলি না কেন, তাদের দখলে রাষ্ট্রের অর্থনীতির বিরাট এক অংশ চলে গেছে। কাজেই অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের আরও জোর দিতে হবে। প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের রাজাকার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান এবং তাদের দোসররা কেবল ১৫ আগস্ট ঘটিয়ে চলে গেছে তাই নয়। ১৫ আগস্টের পর গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে গিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টেই আমাদের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, এমনকি বেসামরিক তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাসেও। ক্যান্টনমেন্ট ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর ঠিকানাই ছিল ক্যান্টনমেন্ট। ফলে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতিতে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা বারবার ঘটানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবে কিনা? সম্পর্ক আমরা কোন পর্যায়ে রাখব? এসব বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তা সাপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাকিস্তানীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। সংসদে প্রস্তাব পাস করেছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সামান্য কিছু বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী ব্যবসা করছে। আবার সার্ক ও ওআইসিসহ কিছু আন্তর্জাতিক ফোরামে তাদের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। তবে পাকিস্তানী দূতাবাস এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকা- নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতেই হবে। কারণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ক্ষমতার পালাবদল তথা জুডিসিয়াল ক্যু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেই ভারত বিরোধিতা এবং ক্যান্টনমেন্টের শক্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। তারা এ ষড়যন্ত্র কেবল পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না, বাংলাদেশেও রফতানি করার চেষ্টা করবে। লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×